আবেদ চৌধুরীর এক গাছে পাঁচবার ধান
কৃষকের হাতে কবে যাবে

জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:২৯

বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ডক্টর আবেদ চৌধুরী। ফাইল ছবি
ফলন শেষ হওয়ার পর একটি ধানগাছ পুরোপুরি না কেটে ওই একই গাছে বিভিন্ন মৌসুমে আরও চারবার একই ধান উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ডক্টর আবেদ চৌধুরী। তিনি তার এ আবিষ্কারের নাম দিয়েছেন ‘পঞ্চব্রীহি’। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামের দুই বিঘা জমিতে ধান গবেষণায় যে ফল পাওয়া গেছে, তা গোটা বিশ্বের জন্যই বিস্ময়কর। একবার রোপণে এক ধানের গাছে বছরজুড়ে পাঁচবার ফলনের ঘটনা বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তবে সফল এ গবেষণার প্রায় দুই বছর কেটে গেলেও মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। এমনকি বিস্ময়জাগানো এ ফসল উদ্ভাবক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ধান গবেষক ও জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর সঙ্গে সরকারের কেউ যোগাযোগ করেনি। তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ধানটি সম্প্রসারণের প্রস্তাব দিলেও তা ফিরিয়ে দিয়েছেন আবেদ চৌধুরী। তিনি এই উদ্ভাবন কোনো ব্যবসায়িক কাজে নয়, গরিব মানুষের জন্য বিলিয়ে দিতে চান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সহায়তা পেলে ধানের জাতটি সম্প্রসারণ সহজ হবে। কারণ দেশীয় পর্যায়ে এ ধরনের ধান গবেষণা ও সম্প্রসারণের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তার প্রশ্নটিও জড়িত।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রাম। এই গ্রামেরই দুই বিঘা জমিতে চাষ হয়েছে ‘পঞ্চব্রীহি’ ধান। একবার রোপণে এ ধানের গাছে বছরজুড়ে পাঁচবার ফলন এসেছে। ধানের এ নতুন জাতের উদ্ভাবক আবেদ চৌধুরী জানান, বোরো হিসেবে বছরের প্রথমে লাগানো এ ধান ১১০ দিন পর পেকেছে। ওই গাছেই পর্যায়ক্রমে ৪৫ দিন পরপর একবার বোরো, দুবার আউশ এবং দুবার আমন ধান পেকেছে।
এক গাছে পাঁচ ফলনের এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে আবেদ চৌধুরী আছেন তার উদ্ভাবন আরও এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়। তিনি ওই গাছেই ছয়বার ফসল তোলার গবেষণা চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি নতুন জাতের ধানটি সারা দেশেই চাষাবাদ সম্ভব কিনা তা যাচাই করবেন। এজন্য বিভিন্ন জেলায় এ ধানের পরীক্ষামূলক চাষ করবেন।
আবেদ চৌধুরীর ভাষ্য, কম সময়ে পাকা এই ধানের উৎপাদন বেশি, খরচও কম। তবে প্রথম ফলনের চেয়ে পরের ফলনগুলোতে উৎপাদন কিছুটা কম। কিন্তু পাঁচবারের ফলন মিলিয়ে উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের সন্তান আবেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন ২০ বছর। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ রকমের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। আবেদ চৌধুরী বংশগতি বিষয়ক গবেষক। একদল অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীর সঙ্গে তিনি ফিস (ইন্ডিপেনডেন্ট সিড) জিন আবিস্কার করেন। তিনি লাল রঙের চাল ও রঙিন ভুট্টাও উদ্ভাবন করেছেন। তার ডায়াবেটিস ও ক্যানসার প্রতিরোধক রঙিন ভুট্টা বিশ্বব্যাপী আলোচিত। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন ও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা করছেন। পেশাগত কারণে বিদেশের মাটিতে গবেষণা করলেও দেশে তার গ্রাম কানিহাটিতে গড়ে তুলেছেন খামার।
আবেদ চৌধুরী বলেন, ‘আম-কাঁঠালের মতো বছরের পর বছর টিকে থাকার সৌভাগ্য ধান গাছের হয় না- এটা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। তাই নেমে পড়ি গবেষণায়।’
ধান গাছের দ্বিতীয় জন্ম নিয়ে ১৪ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান আবেদ চৌধুরী। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে কানিহাটি গ্রামে ২৫ বর্গমিটারের একটি ক্ষেতে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে চীন, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের ও স্থানীয় ধানের জাত ছিল। যে জাতগুলোর ধান পাকার পর কেটে নিয়ে গেলে আবার ধানের শীষ বের হয়, সেগুলো তিনি আলাদা করেন। এভাবে ১২টি জাত বের করেন। তিন বছর ধরে জাতগুলো চাষ করে দেখলেন, নিয়মিতভাবে এগুলো দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে। তারপর তিনি শুরু করেন একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা। তাতেও সফল হলেন। কিন্তু এর মধ্যে চারটি জাত ছাড়া বাকিগুলো চতুর্থবার ফলন দিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।
আবেদ চৌধুরী জানান, চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এই চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলছে গবেষণা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোরো ধানের এই চারটি জাত দুই বিঘা জমিতে রোপণ করা হয়। পরিমাণমতো ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। সঠিকভাবে সেচ ও পরিচর্যা করার পর ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলা হয়। মে মাসে প্রথম দিকে প্রথমবার কাটা ধানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে চার টন। তারপর থেকে ৪৫ দিন অন্তর প্রতিটি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি কখনো দুই টন, কখনো তিন টন ফলন এসেছে। সবগুলো জাত হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬ টন ফলন দিয়েছে।
বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী বলেন, দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে জাতগুলো করা হয়েছে। স্থানীয় জাতের সঙ্গে বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাত এবং স্থানীয় জাতের সঙ্গে স্থানীয় হাইব্রিড জাতের সংকরায়ণ ঘটানো হয়েছে। ১০-১২ বছর আগে এগুলো থেকে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার ফলন দেওয়ার জন্য উপযোগী করে চিহ্নিত করা হয়।
নতুন ধানের নামকরণ বিষয়ে আবেদ চৌধুরী বলেন, একই গাছের শরীর থেকে পাঁচবার ধান বেরিয়ে আসে। ফলে এই ধানের তিনি নাম দিতে চান ‘পঞ্চব্রীহি’। পঞ্চব্রীহি কথাটি ট্রেডমার্ক করে ফেলব। এরপর এটির উৎপত্তি যে আমাদের এলাকায়, এর প্রমাণ দেখিয়ে স্বীকৃতি চাইব।
পঞ্চমবার ফলন দেওয়া ধান উদ্ভাবন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে আবেদ চৌধুরী বলেন, এর আগে আমি অন্য ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। দু’বার ফসল হয়, এমন ধানও উদ্ভাবন করেছিলাম; যাকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ‘রাইস টুআইস’ বলেছে। আবার অনেকে ‘জীবন বর্ধিত ধান’ বলেছে। এই প্রথম সারা বছর ধরে আমার অন্য আরেকটি ধানের জাত মাঠে থাকল। এ ধানের চারা ৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হয়। ফলে গাছটি মাটি থেকে ভালোভাবে শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে এবং একটি ধান গাছ থেকে আরও বেশ কয়েকটি ধান গাছ গজাতে থাকে।
এই ধান পরিবেশবান্ধব উল্লেখ তিনি বলেন, কোনো একটি জমি যতবার চাষ দেওয়া হবে, ততবার মিথেন গ্যাস ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। একবার চাষ দিয়ে দুবার ফসল উৎপাদন করলে খরচ কমে যাওয়ার পাশাপাশি তা কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমিয়ে এনে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।
ধানের এই জাতগুলোকে দেশের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে আবেদ চৌধুরী জানান, এ ধানের বীজ সংগ্রহ সহজ। কৃষকরা নিজেরাই তা করতে পারবেন। তিনি বলেন, আপাতত আমি নিজের খরচে কানিহাটিতে পরীক্ষামূলক চাষ করছি। সারা দেশের ফলাফল বিশ্নেষণ করে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ধানের বীজ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে ভাবব। এ নতুন ধান চাষ পদ্ধতি যদি সারা দেশের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আগামী ৫০ বছরের জন্য গোটা জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
এ নতুন ধান উৎপাদন পদ্ধতি বাণিজ্যিক উপায়ে ব্যবহার করা হবে, নাকি সাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে ছড়িয়ে দেওয়া হবে এ প্রশ্নের উত্তরে আবেদ চৌধুরী বলেন, বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা শেষে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি এটিকে সহজলভ্য করে দেব আমার দেশের দরিদ্র কৃষকদের জন্য। আমার এ আবিষ্কারের গবেষণাগার হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত মৌলভীবাজারের কানিহাটি গ্রাম, যে গ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেখানে আমার গবেষণার সহযোগী ছিলেন স্বল্পশিক্ষিত, নিরক্ষর কৃষক যাদের গায়ে লেগে থাকে বাংলার জল-কাদার গন্ধ। এসব নিরক্ষর, সরলপ্রাণ, দেশপ্রেমিক কৃষককে সঙ্গে নিয়ে আমি বিশ্বকে উপহার দিতে চাই উৎপাদনের শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞান। আমি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আমার আবিষ্কার ব্যবহার করতে চাই না।
সরকারের কেউ এ ধান নিয়ে যোগাযোগ করেছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পঞ্চব্রীহি ধান আবিষ্কারের দুই বছর হলো। সরকারের কেউ যোগাযোগ করেনি। এটির ব্যাপারে বিদেশিরা আমাকে অনেক প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমি তাদের পরিষ্কার বলে দিয়েছি- এটি নিয়ে বাংলাদেশের বাইরে কোনো চিন্তা করব না। কারণ এটি এ দেশের ধান।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, মাটি, গাছ, প্রজনন, বায়োকেমিস্ট্রি ও জিনসহ সব ব্যবস্থাপনা দেখতে হবে। আবেদ চৌধুরী শুধু জিনের অবস্থা দেখছেন। লাভক্ষতি হিসাব করতে হবে। শুধু উদ্ভাবন করলে হবে না, ফলন আশাব্যঞ্জক না হলে কৃষক তা নেবে না।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, একটি ধানের গাছ থেকে একাধিকবার ফসল সম্ভব, কিন্তু ফলন কম হবে। এটি টেকসই কোনো উদ্ভাবন নয়। যেখানে আমরা জমিতে আরও বেশি উৎপাদনের চেষ্টা করছি, সেখানে তিনি খরচ বাঁচানোর জন্য উৎপাদন কমানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তো লাভ নেই। এসব বিষয় নিয়ে আবেদ চৌধুরীর সঙ্গে আমরা একাধিকবার কথা বলেছি। তাকে আমরা দাওয়াত দিয়েছি, কিন্তু তিনি আসেন না।
এ বিষয়ে কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেন, ধানটি গবেষণা পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে কৃষি বিষয়ক সরকারি সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। এই ধান কৃষকের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে পারে কৃষি ও পরিবেশ বিষয়ে তৎপর বেসরকারি সংস্থাগুলোও। একই সঙ্গে জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি ও সম্মাননা প্রদানের দাবিও অসঙ্গত হতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন তার গবেষণা সাদরে গ্রহণ করছে, তখন তার স্বদেশ পিছিয়ে থাকবে কেন?