
ফলমূল ও শাক-সবজিতে কীটনাশকের অতিরিক্ত উপস্থিতি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। ছবি: সংগৃহীত
অনিরাপদ কীটনাশক ব্যবহারে নানাবিধ রোগে ভুগছে কৃষক। সচেতনতার অভাবে কৃষক কীটনাশকের নিরাপদ ব্যবহার করতে না পারায় সারা দেশের মানুষ এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনিরাপদ কীটনাশক ও সারের ব্যবহার যে পরিমাণ বেড়েছে সে তুলনায় ফসলের উৎপাদন বাড়ছে না।
কীটনাশকের ব্যবহার শুধু যে ফসলের উৎপাদন খরচই বৃদ্ধি করে তা নয়, ফলমূল ও শাক-সবজিতে কীটনাশকের অতিরিক্ত উপস্থিতি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকের প্রভাবে আজ জীববৈচিত্র্যও হুমকির সম্মুখীন। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের মাছসহ অন্যান্য প্রজাতির জীব।
কীটনাশক ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় যেসব রোগ হচ্ছে
নিউইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালায়েন্স ফর সায়েন্সের মো. আরিফ হোসেন বলেন, কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহার করার পর বেশ কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা বলেন। যেমন মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, চোখ ও শরীরে অ্যালার্জি সৃষ্টি হওয়া, বমি বমি ভাব ইত্যাদি। দীর্ঘস্থায়ী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ লিউকেমিয়া, ফুসফুসের কান্সার, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, হরমোনাল পরিবর্তন, ডিএনএর ক্ষতি, জন্মদানে জটিলতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য রোগে ভোগে।
কীটনাশক বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিমাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষিজ ও প্রাণিজ খাদ্যের মাধ্যমে কীটনাশক মানবদেহে প্রবেশ করে হার্ট, কিডনি, লিভার, স্নায়ু, ত্বক আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া নানাবিধ ফলমূলে রাসায়নিক পাউডার দিয়ে কাঁচা ফল, এমনকি টমেটো পর্যন্ত রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় টসটসে করে পাকানো হচ্ছে। শুঁটকি মাছে ডিডিটি পাউডার ব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এই বিষ শেষ পর্যন্ত খাবারের মাধ্যমে মানুষের দেহে যাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষক বালাইনাশক প্রয়োগের পর অপেক্ষমাণ সময় বা প্রি-হারভেস্ট ইন্টারভ্যাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই ফসল সংগ্রহ ও বাজারজাত করছেন।
সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় সব কৃষক কীটনাশক স্প্রে করার সময় তাদের পা ঢাকার কোনো কিছু ব্যবহার করে না, মাত্র ২ শতাংশ কৃষক হাত মোজা বা গ্লাভস ব্যবহার করেন, ৩ শতাংশ কৃষক নিরাপত্তার জন্য চশমা ব্যবহার করেন এবং ৬ শতাংশ কৃষক কাপড় দিয়ে মাস্কের মতো করে নাক ঢেকে রাখেন।
কীটনাশকের অপেক্ষমাণ সময় মানছে না কৃষক
একটি কীটনাশক প্রয়োগের কত দিন পর ফলমূল ও শাক-সবজি সংগ্রহ করা যাবে এর একটি গাইডলাইন রয়েছে। এই গাইডলাইন অনুসারে, প্রতিটি বালাইনাশকের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট অপেক্ষমাণ সময় রয়েছে, কিন্তু সচেতনতার অভাবে কৃষক এই গাইডলাইন মানছেন না। অপেক্ষমাণ সময় ফসলভেদে ও কীটনাশকের প্রকারভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন সিনথেটিক পাইরিথ্রয়েড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৪ থেকে ৭ দিন, অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮ থেকে ২০ দিন, নিওনিকোটিনয়িড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮ থেকে ২০ দিন এবং কার্বামেট কীটনাশকের ক্ষেত্রে প্রয়োগের পর ২০ থেকে ৪০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষমাণ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফলমূল ও শাক-সবজি সংগ্রহ করা হলে ফলমূল ও শাক-সবজিতে ব্যবহৃত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের মাত্রা ক্ষতিকর পর্যায় বা সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার নিচে চলে যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের বালাইনাশক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাজার থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন সবজির ৮ থেকে ১২ শতাংশ নমুনায় বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে ছিল এবং বিশ্লেষণকৃত বিভিন্ন প্রকার ফলের ৩ থেকে ৪ শতাংশ নমুনায় প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে পাওয়া গেছে। ফলমূল ও শাক-সবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ মানুষের পেটে গেলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় এবং এতে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হ্রাস পাবে।
ফল ও শাক-সবজি থেকে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক ড. মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রধান বলেন- ফলমূল, শাক-সবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নেওয়ার মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। ধোয়ার সময় এক মিনিট হাত দিয়ে এগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করা উচিত।
এ ছাড়া ফলমূল, শাক-সবজি থেকে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করার জন্য লবণ-পানির দ্রবণে ডুবিয়ে রাখলে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের বালাইনাশক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গবেষণাগারে এক লিটার পানিতে ২০ গ্রাম খাবার লবণ (২ শতাংশ লবণ-পানির দ্রবণ) মিশিয়ে ১৫ মিনিট পর্যন্ত ফলমূল, শাক-সবজি ডুবিয়ে রাখলে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।
এ ছাড়া যেসব সবজি ও ফলের বাইরের আবরণ ছাড়ানো যায় অর্থাৎ যেসব ফলমূলে বা সবজিতে খোসা রয়েছে সেগুলো ছাড়িয়ে রান্না করলে শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর হয়ে যায়। সাধারণত রান্না করার মাধ্যমে শাক-সবজি থেকে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। রান্নার সময়কাল, তাপমাত্রার পরিমাণ, খাদ্যদ্রব্যে পানি সংযোজনের পরিমাণ এবং রান্নার ধরনের (খোলা বা বন্ধ) ওপর নির্ভর করে এর কার্যকারিতা।
সাধারণত খোলা পদ্ধতিতে (ভোলাটিলাইজেশন) এবং বন্ধ পদ্ধতিতে (হাইড্রোলাইসিস) রান্নার মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ হ্রাস করা যায়। এই ৪ পদ্ধতি অবলম্বন করে ফলমূল ও শাক-সবজি থেকে বালাইনাশকের প্রকারভেদে শতকরা ৩০ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে প্রতিবছর ৫০ লাখ কৃষি শ্রমিক কীটনাশক প্রয়োগ করতে গিয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ২০ হাজার শ্রমিক এর প্রতিক্রিয়ায় মারা যায়। তাছাড়া প্রায় ২০০ বিভিন্ন ধরনের রোগ রয়েছে যেগুলোর মধ্যে ক্যান্সার, কিডনি রোগ, ত্বকের সমস্যা, নার্ভাস সিস্টেম নষ্ট হওয়াসহ শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করছে।
আমদানি-নিষিদ্ধ কীটনাশক ব্যবহার
উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলছেন, খাদ্যে ধাতবের উৎস হলো কিছু সার, কীটনাশক, আগাছা নিধনকারী ওষুধ এবং বায়ুদূষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ১৩টি কীটনাশক আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু সেগুলোর বেশ কয়েকটি বাংলাদেশে অবাধে বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে। কোনো ধরনের সরকারি নজরদারি নেই। বাংলাদেশে আধুনিক কৃষিতে রাসায়নিক সারের পাশাপাশি কীটনাশকের ব্যবহার করা হয় ব্যাপকভাবে। তার মধ্যে ডিডিটিসহ অন্যান্য অনেক কীটনাশকের কারণে পরিবেশ ও মানুষের জন্য অবর্ণনীয় ক্ষতি। তবু ফসল উৎপাদনে এসব কীটনাশক ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ কোম্পানি বছরে ৪০ হাজার টন কীটনাশক আমদানি করে। অপরদিকে কৃষি শ্রমিকের মাত্র ১ শতাংশ নিরাপদ মাত্রায় কীটনাশক দিতে জানে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্ল্যান্ট প্রটেকশন ইউনিট কীটনাশকের অনুমোদন দেয়, কিন্তু তারা মানুষের শরীরে ও পরিবেশে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে কোনো দায়িত্ব নেয় না।
ফরিদা আখতার বলছেন, বাংলাদেশে বছরে ২৭ লাখ টন সার ব্যবহার হয় কৃষিতে, এ সারের বেশির ভাগই ব্যবহার হয় ধান চাষে। এখন প্রতি হেক্টর জমিতে আগের তুলনায় বেশি সার দিতে হয়। ২০০২ সালে প্রতি হেক্টরে ১৮৮ কেজি সার দিয়ে ফসল উৎপাদন করে ফেলতে পারলেও ২০১৬ সালে তা বেড়ে ২৮৯ কেজি ব্যবহার করতে হয়ে। এই কয় বছরের ব্যবধানে ১০০ কেজি বেশি সার দিতে হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই তুলনায় ফসলের উৎপাদন বাড়েনি। সার দেওয়ার কারণে মাটি নষ্ট হচ্ছে, পানিতে মিশে নদী-বিলের পানি বিষাক্ত হচ্ছে। মরছে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮২-৮৩ সালে ইউরিয়া সার বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ২৯ হাজার টন, ২০০৫-০৬ সালে ইউরিয়ার বিক্রি ৪ গুণ বেড়ে হয়েছে ২৪ লাখ ৫১ হাজার টন। শুধু যে ফসল উৎপাদনে কীটনাশক (পেস্টিসাইড) ব্যবহার হচ্ছে তাই নয়, বাংলাদেশে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার ১৯৫০ সাল থেকে শুরু হয়। ফসলের ক্ষেতে সার বা কীটনাশকের অতিব্যবহারের কারণে জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়েছে এবং ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ধ্বংস করতে গিয়ে ফসলের উপকারী পোকামাকড়ও ধ্বংস হচ্ছে। কীটনাশকের কারণে বহু বিল, হাওর মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। বহু প্রজাতির পাখি অদৃশ্য হয়ে গেছে। ফসল রক্ষাকারী পোকামাকড় ধ্বংসের কারণে প্রতিবছর ১২০০ থেকে ১৮০০ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হচ্ছে।