
ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে; অর্থনীতির আকার ও অন্তর্গত শক্তিও বাড়ছে জোর কদমে। পাল্টে যাচ্ছে নাগরিকের জীবনমান। সমাজে এর প্রতিফলন স্পষ্ট। উন্নত, স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন এখন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক সংস্কৃতি। সামাজিক চাহিদার এ রূপান্তর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষির পাশাপাশি যোগাযোগের মতো অত্যাবশ্যক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর নির্ভরযোগ্যতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। স্থলপথে যাতায়াতের অন্যতম নিরাপদ ও আরামদায়ক মাধ্যম হলো রেলপথ। পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রেলগাড়ি একটি জনপ্রিয় পরিবহন। রেল সেক্টর নিয়ে তাই সরকারেরও নানা পরিকল্পনা। এরই মধ্যে দীর্ঘ ৩০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন করা হয়েছে। তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন রেলপথ, হাতে নেওয়া হচ্ছে মেগা সব প্রকল্প। তবে এসব কর্মকাণ্ড ঘিরে ঋণের ফাঁদে পড়ছে না তো বাংলাদেশ রেলওয়ে- এমন প্রশ্নও তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) হিসাবে, দেশের ব্যস্ততম রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রামে প্রতিবছর ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে যাত্রীর চাহিদা। পণ্য পরিবহন চাহিদা বাড়ছে বছরে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। ক্রমবর্ধমান এ চাহিদা পূরণে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে লাইনের (ট্র্যাক) সংখ্যা একটি থেকে দুটিতে উন্নীত করা হয়েছে। এজন্য তিন ধাপে খরচ হয়েছে ১০ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। দুই ধাপে রেলপথটির টঙ্গী-ভৈরব এবং লাকসাম-চিনকি আস্তানা অংশ ডাবল লাইন চালু হয় ২০১৮ সালে। শেষ ধাপে আখাউড়া-লাকসাম অংশ চালু হয় চলতি বছরের জুনে। বিপুল পরিমাণ ব্যয়ে রেলপথটি চালু করার পর এতে এখন পর্যন্ত নতুন করে শুধু একটি পণ্যবাহী কনটেইনার ট্রেন চালু করতে পেরেছে রেলওয়ে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে কক্সবাজার এক্সপ্রেস নামে নতুন একটি ট্রেন চালু হলেও এর জন্য আলাদাভাবে বিনিয়োগ করতে হয়েছে আরও প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থের পুরোটাই ব্যয় হয়েছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন ট্র্যাক বসানোয়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যখন একটি লাইন ছিল তখন দৈনিক ৩৬টি ট্রেন চলার সক্ষমতা ছিল। দুটি লাইন হওয়ায় রেলপথটি এখন প্রতিদিন ৭২টি ট্রেন চালানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। পাশাপাশি আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত লম্বা ট্রেন (অধিকসংখ্যক কোচ বা কনটেইনার/লাগেজ ভ্যান সংবলিত ট্রেন) পরিচালনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সর্বশেষ টাইম টেবিলের (৫৩ নম্বর) তথ্য বলছে, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ব্যবহার করছে ৭২টি ট্রেন। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন রয়েছে ৩৮টি। মেইল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেনের সংখ্যা ২৬। আর আটটি কনটেইনার ট্রেন। যেখানে ১৮টি যাত্রীবাহী ও আটটি পণ্যবাহী ট্রেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের পুরোটাই ব্যবহার করছে। বাকি ট্রেনগুলো আংশিকভাবে ব্যবহার করছে এ রুট।
রেলওয়ে এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কোনোটারই চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী রুট বিন্যাস করতে হয়, যা বাংলাদেশ রেলওয়েতে খুব একটা দেখা যায় না। আবার পণ্য পরিবহন বাড়ানোর জন্য শুধু লাইন হলেই চলে না, পণ্য ওঠানামার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো বা আইসিডি) লাগে। রেলওয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করতে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, পণ্য পরিবহন অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য এর সিকিভাগও দেওয়া হয়নি। তাহলে পণ্য পরিবহন বাড়বে কীভাবে? সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেন চলাচলের সক্ষমতা আরও বাড়ানো সম্ভব।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয় তিনটি আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে টঙ্গী থেকে ভৈরব পর্যন্ত ডাবল লাইন করা হয়। ২০০৬ সালে শুরু হয়ে এ কাজ শেষ হয় ২০১৮ সালে। এতে খরচ হয় ২ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা।
১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকায় লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত রেলপথটি ডাবল লাইন করা হয়। এ রেলপথের কাজও ২০১৮ সালে শেষ হয়। সর্বশেষ আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত রেলপথটি ডাবল লাইন করা হয়, যাতে খরচ হয় ৬ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে এ অংশটি পুরোপুরি চালু হয়েছে।
ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন একটি রেলপথ তৈরি করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রায় ৭৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটি নির্মাণ করা হয়েছে শতভাগ সরকারি অর্থায়নে, যার কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের জুনে। ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। ঈশ্বরদী-ঢালারচর রেলপথ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি। সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসার, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপন, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে এবং রিজিওনাল কানেক্টিভিটির নতুন ও বিকল্প রেল রুট স্থাপন করাও ছিল এ রেলপথ নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য। যদিও বিপুল অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে তোলা এ রেলপথে বর্তমানে চলাচল করছে মাত্র একটি ট্রেন।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল বিনিয়োগে গড়ে তোলা এই রেলপথে একটি মাত্র ট্রেন পরিচালনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘এ ধরনের বিনিয়োগের সাধারণ উদ্দেশ্য হলো দুটি। প্রথমটি যাত্রী সেবা, দ্বিতীয়টি রাজস্ব আয়। দিনে মাত্র একটি ট্রেন পরিচালনা করে ওই অঞ্চলের যাত্রীসেবা কতটা দেওয়া হচ্ছে, যাত্রীদের চাহিদা কতটা পূরণ হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। রেলপথটি নির্মাণের আগে কি যাত্রীদের চাহিদা কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে পর্যালোচনা করেছিল?’
তিনি বলেন, ‘রেলপথটি নির্মাণে পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এটা হলো এককালীন বিনিয়োগ। এর বাইরে বর্তমানে স্টেশন পরিচালনা, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণসহ ট্রেন পরিচালনার আনুষঙ্গিক কাজে রেলওয়েকে কিন্তু প্রতিদিন ব্যয় করতে হচ্ছে। একটি ট্রেন পরিচালনা করা হোক বা একের বেশি, এই পরিচালন ব্যয়ে কিন্তু খুব তারতম্য হওয়ার কথা না। এত বিনিয়োগ করেও একটি মাত্র ট্রেন পরিচালনার কারণে রেলপথটি থেকে রাজস্ব আয় তো হওয়ার কথা নয়। আমি এক কথায় বলব, এটা হলো রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, ‘রেলওয়েতে জনবল রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ কারণে আমরা চাইলেও বিভিন্ন রুটে আমাদের পরিচালন কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে পারছি না। তবে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া আমাদের চলমান রয়েছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল পেলে বিভিন্ন রুটে আমরা নতুন ট্রেন চালু করতে পারব।’