Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

তোপখানা রোড

ব্রিটিশ কলোনি থেকে বামপন্থিদের সংগ্রামের মঞ্চ

Icon

সেলিম আহমেদ

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:২৫

ব্রিটিশ কলোনি থেকে বামপন্থিদের সংগ্রামের মঞ্চ

পাকিস্তানি শাসনামলে তোপখানা ও পল্টন এলাকায় কিছু নতুন বাড়িঘর গড়ে উঠতে থাকে।

তোপখানা। এক সময় এ এলাকাতেই ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনানিবাস। ছিল গোলন্দাজ বাহিনীর কামান আর গোলা বা তোপ রাখার সুরক্ষিত এলাকাও। ফলে ধীরে ধীরে পল্টন এলাকার সড়কটি নাম পায় তোপখানা রোড হিসেবে, হয়ে ওঠে এই ভূখ-ের কয়েকশ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। আর স্বাধীনতার কয়েক বছর পর থেকে তোপখানা রোড রূপ নেয় বামপন্থি আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রে। নানা আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রপাত এখান থেকেই। 

পুরনো ইতিহাস
একটি নতুন সেনানিবাস তৈরির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ আমলে ঢাকার তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ড’স নবাবপুর ও ঠাটারীবাজার ছাড়িয়ে শহরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বেশকিছু অংশ সংস্কার করেন। সেখানে সিপাহিদের ছাউনি, অফিসারদের বাসস্থান এবং প্যারেড গ্রাউন্ড করা হয়। পুরানা পল্টন, পুরানা পল্টন লেন, নয়াপল্টন, তোপখানা এবং ফুলবাড়িয়া রেলপথ পর্যন্ত ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনানিবাস। তোপখানায় তখন একটি আর্টিলারি বাহিনী ছিল। ১৮৪০ সালে সেনানিবাসটি রমনা, বেগুনবাড়ী, পরে লালবাগ দুর্গে এবং ১৮৫৭ সালের পর মিল ব্যারাকে স্থানান্তর হয়। 

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বাংলা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর পাকিস্তানি শাসনামলে তোপখানা ও পল্টন এলাকায় কিছু নতুন বাড়িঘর গড়ে উঠতে থাকে। 

স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তোপখানা
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বাম রাজনীতির ব্যাপক উত্থান হয়। আর তোপখানা পরিচিতি পায় ‘বামপন্থি পাড়া’ হিসেবে। কারণ বহুকাল ধরে দেশের অধিকাংশ বাম রাজনৈতিক দলের অফিস তোপখানায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এসব ‘পার্টির’ পরিসরেই এই এলাকায় শত শত পরিবর্তনবাদী তরুণ-তরুণীর বিচরণ এবং বেড়ে ওঠা। স্বাধীনতার পরপরই তোপখানায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে ঘটে এক ট্র্যাজেডি। ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) উদ্যোগে ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। তারা সংগ্রামী ভিয়েতনামি নাগরিকদের সমর্থনে বিভিন্ন ধরনের সেøাগান দেন।

বিক্ষোভ মিছিলটি তোপখানা রোডের তৎকালীন মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের (বর্তমানে জাতীয় প্রেসক্লাব) সামনে পৌঁছলে বিনা উসকানিতে পুলিশ মিছিল লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ছাত্রনেতা মির্জা কাদেরুল ইসলাম ও মতিউল ইসলাম। আহত হন ছাত্র ইউনিয়নের অসংখ্য নেতাকর্মী। সদ্য স্বাধীন দেশে এই প্রথম কোনো বাঙালির হাত বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়। এরপর সদ্য স্বাধীন দেশ ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয় রাজধানী শহর ঢাকা। সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ভিয়েতনাম সরকার ২০০২ সালে শহীদ মির্জা কাদেরুল ইসলাম ও মতিউল ইসলামকে ‘জাতীয় বীর’-এর মর্যাদা দেয়। এ ছাড়া সে দেশের দুটি রাস্তার নাম এই দুই বীরের নামে নামকরণ হয়। 

আশি-নব্বইয়ের দশকে তোপখানা
আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে শুভ্র সকাল কিংবা সন্ধ্যা রাত, মিছিলে-স্লোগানে মুখরিত থাকত তোপখানা রোড। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আলোক প্রজ্বলন হতো। কখনো মোমবাতি জ্বেলে, কখনো মশাল নিয়ে বের হতো মিছিল। রাজনৈতিক সংকট, অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই রোডেই সোচ্চার থাকতেন দেশের বাম রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। সেই সঙ্গে জনসম্পৃক্ত নানা দাবি নিয়ে রাজধানীর রাজপথে অব্যাহত কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে সময় পাল্টেছে। আগের মতো বাম দলগুলোর নেই রাজনৈতিক শক্তি। তাই এখন আর কোনো বড় কর্মসূচি চোখে পড়ে না। তারপরও এই রোডে অবস্থিত জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়কই নিপীড়িত-নির্যাতিত আর প্রতিবাদের শেষ ভরসাস্থল।

১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদের পতনের পর নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয় তোপখানার পার্শ্ববর্তী পল্টন ময়দান। ঢাকার গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের স্মারক এ ময়দানটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুই নেত্রী শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া বিভিন্ন মেয়াদে জনসমর্থনের ‘শোডাউন’ ভেন্যু হিসেবে বেছে নেন।

২০০৬ সালের উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি প্রকল্প বাতিল, জাতীয় সম্পদ রক্ষা এবং বিদেশি কোম্পানি এশিয়া এনার্জিকে দিনাজপুর থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে তোপখানার রাজপথে নেমেছিল বাম দলগুলো। প্রকল্পটিকে ‘ক্ষতিকর’ আখ্যা দিয়ে তা প্রতিরোধে সিপিবি, বাসদ ও বাম মোর্চা মিলে নানা কর্মসূচি পালন করে।

এক-এগারোর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও ২০০৮ সালের ১৩ জানুয়ারি তোপখানা রোড কেঁপে উঠেছে মিছিলে-স্লোগানে। মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করেছে সিপিবি, বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্বাধীন গণমুক্তি আন্দোলন। রাজনৈতিক নানা ইস্যু রয়েছে এখনো। কিন্তু আগের মতো মিছিল-সমাবেশ নেই।

বর্তমান অবস্থা
তোপখানায় নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ২০-২৫টি রাজনৈতিক দলের অফিস থাকলেও নেই আগের মতো রাজপথের কর্মসূচি। পোস্টার, লিফলেট বিতরণ ও ঘরোয়া আলোচনাতেই বেশিরভাগ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্টদের।

তবে সমাজ-রাষ্ট্রের জাগ্রত বিবেক বলে আখ্যায়িত সাংবাদিকদের মিলন কেন্দ্র জাতীয় প্রেসক্লাবও এই তোপখানা রোডেই অবস্থিত। তাই প্রতিদিনই নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ তাদের দাবিদাওয়া কিংবা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের ছোট ছোট কর্মসূচি পালন করে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায়। যার ফলে তোপখানা রোডের আবেদন এখনো খুব একটা ফুরায়নি। 

তোপখানা রোড নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান বলেন, তোপাখানার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল, এখনো আছে। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। 

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো এখন বহু ভাগে বিভক্ত। রয়েছে মতানৈক্য। তা ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে সেভাবে কর্মসূচি পালন করতে পারছেন না তারা।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, আগে বাম দলগুলো শক্তিশালী ছিল, আন্দোলনও হয়েছে। এখন তাদের খুব একটা অস্তিত্ব নেই। যেগুলো আছে তারা হয় আওয়ামী লীগ না হয় বিএনপির সঙ্গে। তাদের জনসমর্থনও খুব একটা নেই। তাই শক্তিশালী আন্দোলন হয় না। তোপখানা রোডও তাই শান্ত।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫