
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে চলছে অঘোষিত লকডাউন। অফিস আদালত থেকে শুরু করে শিল্পকারখানা, দোকানপাট সবকিছুই বন্ধ। অচলাবস্থার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে নানা সংকটের কৃষিখাতেও।
অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে সরকার শিল্পপতিদের জন্য বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। সবার শেষে একটি প্যাকেজ দেয়া হয়েছে কৃষকদের জন্যও। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, সেটি প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য।
দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষের জীবিকা কৃষিখাতের ওপর নির্ভরশীল। এই খাতের অবস্থা বরাবরই সবচেয়ে বেশি নাজুক। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার কৃষক। তাই তাদের জন্য সুদবিহীন ঋণ ও এককালীন সহায়তা দিতে হবে। পণ্যবিক্রির বাজার সচল করতে ও কৃষিখাতে শ্রমিক সংকট দূর করতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতে শিল্পের অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়ছে। এরপরও এখন দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগের জীবিকা চলে কৃষির ওপর ভিত্তি করে। মোট জনশক্তির প্রায় ৪০ ভাগই কৃষি খাতে নিয়োজিত। তবে এর বাইরে অনানুষ্ঠানিক খাতে বহু মানুষ কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান বাড়লেও দেশে মোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৬ হাজার ২৯১টি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫৮ লাখ ৮০ হাজার মানুষের।
করোনাভাইরাস সংক্রমণে সব খাতই আক্রান্ত। তবে নায্যমূল্য না পাওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যসহ আগে থেকেই সংকটে থাকা দেশের কৃষিখাত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দিনভর কঠোর পরিশ্রম করেও জীবন চালানো দায় গ্রামের কৃষকদের। করোনার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে কৃষি পণ্যেও। ঢাকাসহ সারাদেশের বাজারে যেসব কাঁচা তরকারি ও সবজির সরবরাহ হয়, এর বেশিরভাগ আসে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলো থেকে। একটি অংশ আসে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকে; কিন্তু সরবরাহ লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকার বাজারে যেমন এসবের দাম বাড়তে শুরু করেছে, তেমনি ক্ষেতেও বাড়তি পণ্য মজুদ হচ্ছে। কৃষক তা ক্ষেত থেকে তুলতে পারছেন না। কিছু এলাকায় সবজি উঠালেও তার দাম মিলছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সাপ্লাই চেইন ঠিক না হলে পণ্যে পচন ধরাসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এর মধ্যে তিনটি বড় অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষ। এই তিনটি অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল ফুলের ব্যবহার। যশোর, ঝিনাইদহ এলাকায় বিশাল ফুলের মাঠ দেশব্যাপী বিপুল পরিমাণ ফুলের চাহিদার জোগানদাতা; কিন্তু এবার তারা ফুল বিক্রি করতে পারেনি। শখের ফুল পশুকে খাওয়াতে ও রাস্তায় ফেলতে বাধ্য হয়েছেন কৃষক। অঘোষিত লকডাউনের কারণে ফুলচাষিরাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত।
দেশের ধান উৎপাদনের বড় মৌসুম বোরো আবাদ। বিভিন্ন এলাকায় বোরো ধান কাটার সময় এসেছে। কিশোরগঞ্জে হাওরাঞ্চলে তা কাটা শুরু হয়েছে। হাওরজুড়ে অর্ধেকেরও বেশি বোরো জমির ধান পেকে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জেলার বাইরে থেকেও কোনো ধান কাটার শ্রমিক যেতে পারছে না সেখানে। ফলে জমির পাকা ধান নিয়ে শ্রমিক সংকটে পড়েছে হাজারো কৃষক।
এদিকে শিলাবৃষ্টি আর আগাম বন্যায় জমি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সব মিলিয়ে হাওরের কৃষক এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এই ধান নষ্ট হলে কৃষক একা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মধ্যে পড়বে।
করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কাঁচা সবজির বাজার। সারাদেশের স্থানীয় বাজার জমজমাট হচ্ছে না। আবার ক্ষেতে সবজি শ্রমিকের অভাবে বাজারে আনা যাচ্ছে না। ঢাকা শহরের সবজি চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগই এক সময় বৃহত্তর যশোর অঞ্চল থেকে সরবরাহ হতো। এখন এর বাইরে উত্তরের কয়েকটি জেলা এবং ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর ঢাকার পাশের জেলাগুলো থেকেও ঢাকায় সবজি সরবরাহ হয়।
৬০ থেকে ২০০ জাতের সবজির মধ্যে প্রধান সবজি প্রায় ২৫টি জাতের। বিপুল পরিমাণ এই সবজি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের অভ্যন্তর ছাড়াও বিদেশে রফতানির ক্ষেত্রেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
পাহাড়ি অঞ্চলের চাষিরা আনারস নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন। জমিতে আনারস পচে যাচ্ছে; কিন্তু বাজারে বিক্রি করার মতো অবস্থা নেই।
খাতা-কলমের অর্থনীতিতে কৃষিখাত বেশ খানিকটা পিছিয়ে; কিন্তু প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের প্রধান ভরসা এখনো কৃষিখাত। দেশের অর্থনীতির ভিত্তিই হচ্ছে কৃষি। কৃষির সবকিছুই টাকার বিনিময়ে হিসাব করা যায় না। এজন্য কৃষিখাত হিসাবের অর্থনীতিতে অনেক ছোট দেখায়।
কৃষকরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী নন। আবার নগরের অধিবাসীরা নগরকেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে সবার আগে উদ্বিগ্ন। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণে কৃষি খাতের ক্ষতি কারও আলোচনায় ছিল না। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রথম পদক্ষেপে কৃষিখাতের নাম তাই আসেনি। ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজে কৃষকের জন্য ছিল না কিছুই। অবশেষে তাদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। শিল্পপতিরা ২ শতাংশ, ৪ শতাংশ ও সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন। অথচ কৃষককে গুনতে হবে সবচেয়ে বেশি ৫ শতাংশ সুদ। এই প্যাকেজ নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করেছেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘চাষিদের এই তহবিলে সুদহার ৫ শতাংশের পরিবর্তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মতো ৪ শতাংশ হলে ভালো হতো। এছাড়া মৌসুমে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে এখন ৪/৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। মৎস্য, হাঁস-মুরগি পালনের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে হবে।’
এছাড়া ধানের মূল্য নিশ্চিত করতে সরকার কর্তৃক বেশি পরিমাণ ধান কেনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘কৃষকের জন্য প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে যার সুদহার তুলনামূলক বেশি। কৃষকের জন্য সুদহার হওয়া উচিত ২%। বাকি তিন শতাংশ সরকার ভর্তুকি দেবে যেমনটি শিল্প প্যাকেজের ক্ষেত্রে দেয়া হয়েছে।’
ব্যাংকগুলো এমনিতেই কৃষককে ঋণ দিতে চায় না। বছর দুয়েক আগে সরকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ কৃষক রয়েছেন। এর মধ্যে ঋণ পেয়েছেন মাত্র ২৫ শতাংশ বা ৬৫ লাখ কৃষক। আবার এই ৬৫ লাখের মধ্যে ৫০ লাখই ঋণ নিয়েছেন এনজিও থেকে। ব্যাংক তাদের ঋণ দেয়নি। প্রতি বছর মোট ঋণের মাত্র ৫ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণের জন্য লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক; কিন্তু এই সামান্য অংশও কৃষককে দিতে চায় না ব্যাংকগুলো। এখন এই প্যাকেজের টাকা কৃষক পাবেন কীভাবে সেটিও দেখার বিষয়।
কৃষি প্যাকেজ সম্পর্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘কৃষি পণ্য ও উপকরণের অভ্যন্তরীণ বাজার ভেঙে পড়েছে। শুধু ঋণ দিয়ে এটি সমাধান করা যাবে না। বাজার কীভাবে সচল করা যায়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। এই মুহূর্তে বড় সংকট বোরো ধানের উৎপাদন নিয়ে। লকডাউনের কারণে শ্রমিকরা যাতায়াত করতে পারছেন না। শ্রমিক সংকট দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্যাকেজের ৫ শতাংশ সুদহার বিবেচনা করতে হবে। তাদের বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে। কেননা আগামী দিনে সবচেয়ে বড় সংকট হবে খাদ্যের। খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কৃষিকে শর্তহীন সমর্থন দেয়ার বিকল্প নেই।’