
দেশে দশ বছরে সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৭৮ হাজার মানুষ। ফাইল ছবি।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। প্রতিবছর প্রাণ যাচ্ছে কয়েক হাজার মানুষের। নানা ধরণের আইন ও নিষেধাজ্ঞা দিয়েও একে থামানো যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় বিষয়, এসব দুর্ঘটনার দায়ভার নিচ্ছে না কেউ । কিন্তু গত দশ বছরে দেশের সড়কে প্রাণ গেছে প্রায় ৭৮ হাজার মানুষের।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল-১০ বছরে সড়কে ৫৬ হাজার ৩৬০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮ হাজার ১০৭ জন নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৬৪৯ জন। এ হিসাবে গড়ে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি এবং ১৪ হাজারের বেশি লোক আহত হয়েছেন। যাদের ৬০ ভাগই হাত-পা বা অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন অবাধে চলাচলের সুযোগ, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, যানবাহন চালক ও মালিকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদকসেবন করে যানবাহন চালানোসহ ১০১টি কারণ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের মোট রোগীর ৫৬ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। হাসপাতালের শয্যাগুলোর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত রোগী থাকেন। এছাড়া দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৬০ শতাংশই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। যাদের বয়স ১৬ থেকে ৪৫ বছর। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু ব্যক্তির জীবনহানিই ঘটে না বরং পারিবারিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। কথায় আছে, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। যে ব্যক্তি অকালে চলে যায়, পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠান তার অবদান থেকে বঞ্চিত হয়।
এদিকে সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধ করতে গাড়ীর গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জানা গেছে, অচিরেই দেশের সব সড়কে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক বলেন, মহাসড়কে বাসের গতির চেয়েও মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে আনায় দুর্ঘটনার হার নিশ্চিত আরও বাড়বে। এছাড়া দেশের সব শহরকে একই গতিসীমার মধ্যে আনা হয়েছে। ঢাকা শহরের যানবাহনের গতি আর রাজশাহী শহরের যানবাহনের গতি এক নয়। আমি মনে করি, নতুন এ নীতিমালা কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন হয়নি। এটি একটি আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত।
তিনি আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন নীতিমালা করতে হবে। গোড়ায় গলদ রেখে মাথায় পানি ঢাললে রোগ সারবে না। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার নেপথ্য কারণগুলো ধরে ধরে সমাধান করতে পারলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বাইরের দেশে লেনভিত্তিক গাড়ি চলে, কোন লেনে কোন গাড়ি চলবে, তাও নির্ধারণ করা থাকে। আমাদের দেশে ঢাকা শহরেই লেনব্যবস্থা চালু নেই। তাছাড়া মহাসড়কে বিভিন্ন শ্রেণির গাড়ির জন্য আলাদা লেন নেই। যে কারণে এ গতিসীমা বেঁধে দেওয়ার কারণে ওভারটেকিং বাড়বে। আর ওভারটেকিং যেখানে বাড়ে, সেখানে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাড়ে। এ গতিসীমা বাস্তবায়ন করা হলে সড়কে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হবে।
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, আমরা আগেও বেপরোয়া গতির যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন গাইডলাইন থাকায় এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আরও সহজ হবে। গাইডলাইন বাস্তবায়ন করা গেলে সড়কে দুর্ঘটনা কমবে বলে তিনি আশাবাদী।
অন্যদিকে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলছেন ভিন্নকথা। তিনি দাবি করেন, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে, তা শুধু বিজ্ঞানসম্মতই নয়, বাস্তবসম্মতও। এ গাইডলাইন কার্যকর হলে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত এবং ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন। ২০২২ সালে ৬৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৯৫১ জন নিহত ও ১২৩৫৬ জন আহত, ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত ও ৯ হাজার ৩৯ জন আহত, ২০২০ সালে ৪ হাজার ৮৯১টি দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত, ২০১৯ সালে ৫৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮৫৫ জন নিহত ও ১৩৩৩০ জন আহত এবং ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার মধ্যে ২০ শতাংশের বয়স ১৬ বছরের নিচে।
২০১৭ সালে ৪৯৭৯টি দুর্ঘটনায় ৭৩৯৭ জন নিহত ও ১৬১৯৩ জন আহত, ২০১৬ সালে ৪৩১২টি দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫৯১৪ জন আহত, ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত ও ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত এবং ২০১৪ সালে ৫ হাজার ৯২৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৮৯ জন নিহত ও ১৭ হাজার ৫২৪ জন আহত হন।