
ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
মতিঝিলে আকাশ ছুঁতে চাওয়া অজস্র দালান, দারুণ ব্যস্ততায় যে পথগুলোতে-মানুষ হেঁটে যায়, গাড়ি ছুটে যায়, তারই নিচে চাপা পড়ে আছে মতিঝিলের ঝিল। নগরায়ণের তোড়ে আমূল বদলে যাওয়া মতিঝিলের ইতিহাস, ঝিল-জলাভূমি আর নৌপথের সঙ্গে মানুষের মিতালির এক সোনালি অধ্যায়ও। দখল হতে হতে অস্তিত্ব বিপন্ন হলেও সেই ঝিল একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ছোট একটি জায়গা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে রয়েছে আজও। বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনেই টিকে থাকা এই ঝিলের অবস্থান।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এ ঘাট খোলা থাকে। আর থাকে মাঝিদের ব্যস্ততা। ১১ মাঝি মিলে এই ঘাট পরিচালনা করেন। দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময় তারা নিজেদের মধ্যে সময় ভাগ করে নিয়ে পারাপারের কাজটি করেন। এ ঘাটের সবচেয়ে প্রবীণ মাঝি হেজু মিয়া। বয়স তার ৭০ পেরিয়েছে। তার মধ্যে ৪০ বছরই কাটিয়েছেন এ ঘাটে নৌকা চালিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ কমলাপুরের গুদারাঘাটে যাত্রী নিয়ে আসেন দারুণ উদ্যমে। দেখে মনে হয় বয়সটা যেন এখনো তার ত্রিশের কোঠায়। মাঝি হেজু মিয়া জানালেন, তিনিসহ তার পরিবারের তিন প্রজন্ম এ ঘাটে নৌকা চালিয়েছেন। পরিবারের মধ্যে তার দাদা প্রথম নৌকা চালানো শুরু করেন মতিঝিলে, এরপর তার বাবা এবং বর্তমানে তিনি চালাচ্ছেন।
মাঝি হেজু মিয়া বলেন, ‘আমি যখন এখানে নৌকা চালানো শুরু করি, তখনো কমলাপুরের এই পুরো এলাকাজুড়ে ঝিল ছিল। আর এখন তো এই ঝিল ৬০ থেকে ৭০ গজে এসে ঠেকেছে। আগে অনেক মানুষ যাতায়াত করত এ ঘাটে, কিন্তু এখন কমে গেছে। এখন দিনে ১০০০ থেকে ১২০০ মানুষ পারাপার হয়।’
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, চারপাশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পিচঢালা রাস্তা থাকার পরও কেন এই ছোট্ট ঝিলের মাঝে আজও নৌকায় যাত্রী পারাপার হয়। এর উত্তর খুঁজতে গেলে চোখ বুলাতে হবে মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে দক্ষিণ কমলাপুর, টিটিপাড়া, মানিকনগর ও গোপীবাগের রাস্তার দিকে। শাপলা চত্বর থেকে সড়কপথে এসব এলাকায় যেতে হলে একটু ঘুরপথ ধরতে হয়, আর যদি নৌকা করে ঝিল পেরিয়ে দক্ষিণ কমলাপুরের কালভার্ট রোডে ওঠা যায়, তাহলেই আর খুব বেশি রাস্তা ঘুরতে হয় না। দক্ষিণ কমলাপুর, টিটিপাড়া, মানিকনগর ও গোপীবাগ এলাকায় এমন অনেক মানুষ বসবাস করেন, যারা মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মূলত তারাই এই ঝিলের নৌপথের যাত্রীর বড় অংশ। তাই এখনো এ ঘাটে নৌকার দেখা মেলে।
মতিঝিলের নামকরণের বিষয়ে জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াসহ বেশ কয়েকটি ইতিহাস-নির্ভর বইয়ের সূত্রে জানা যায়, মোগল আমলে মীর্জা মোহাম্মদ মুকিমের মহল হিসেবে এলাকাটি সমধিক পরিচিত ছিল। এ মহলের ভেতর ছিল একটি বড় দিঘি বা পুকুর, যার নাম ছিল সুকাকু মহলের পুকুর বা দিঘি। সুকাকু পুকুরটিই পরে মতিঝিল নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মোগল সুবেদার মীর জুমলার (১৬৬০-১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে মীর্জা মুকিম নওয়ারা মহলের দারোগা ছিলেন। মীর্জা মুকিমের মহল ছিল পুরানা পল্টন ময়দানের দক্ষিণে। মহলের ভেতরে ও বাইরে ছিল দুটি বড় টিলা, যার একটি এখনো বঙ্গভবন চত্বরে রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, ‘মীর্জা মুকিম তার মানসিক ভারসাম্যহীন পুত্র ও কন্যা সন্তানদের জন্য সর্বস্ব হারান। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মির্জা মুকিম তার কন্যার জন্য যে অলংকার সঞ্চিত রেখেছিলেন, তা থেকে কন্যাটি প্রতিদিন একটি করে অন্দর মহলের এ দিঘিতে ফেলতেন। সম্ভবত তার পরে দিঘিটি সুকাকু মহলের দিঘি থেকে মতিঝিল বা মোতির দিঘি নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে এই মোতির দিঘির নামানুসারেই স্থানটির নাম হয় ‘মতিঝিল’।