
বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দক্ষিণের ব্যাপক উপকূলীয় অঞ্চল। ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দক্ষিণের ব্যাপক উপকূলীয় অঞ্চল। গতকাল রবিবার (২৬ মে) বিকাল থেকেই ‘রিমালে’র প্রভাব শুরু হয়। প্রথমে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ প্রথমে সুন্দরবনে আঘাত হানে। সেই সঙ্গে শুরু হয় জলোচ্ছ্বাস। সন্ধ্যা থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে। ৪শ’ কিলোমিটার আয়তনের বিরাট আকারের ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র মূল কেন্দ্র বা ‘চোখ’ গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে মোংলার পাশ দিয়ে দেশের উপকূলে আছড়ে পড়ে। একটানা ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা যাবত (মধ্যরাতের পর শেষ রাত পর্যন্ত) আঘাত হানে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে হাজারো বসতঘর, হাট-বাজার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মক্তব ও বিভিন্ন অবকাঠামো কমবেশি বিধ্বস্ত হয়। গাছপালা, ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। অনেকেই হতাহত হওয়ার খবর আসছে। বিদ্যুৎ, সড়ক ও নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মোংলার কাছাকাছি দিয়ে বাগেরহাট, পটুয়াখালী, সুন্দরবন, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের মধ্যবর্তী উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করেছে বড়সড় আকারের ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’। ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কি.মি. এবং দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার আকারে সর্বোচ্চ ১৩৫ কিলোমিটার। সমুদ্র খুবই উত্তাল। ঘূর্ণিঝড়ের তোড়ে ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় প্রত্যন্ত দূর্গম দ্বীপ ও চরাঞ্চল।
‘রিমালে’র প্রভাবে বিকালেই চর-উপকূল-দ্বীপাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায় কয়েক ফুট। বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে হু হু করে জোয়ারে প্লাবিত হয়। দক্ষিণের উপকূলে সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্লাবিত হয়েছে সুন্দরবনের ব্যাপক এলাকা। উপকূলের বিভিন্ন জায়গায় জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে শতাধিক গ্রাম। ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র আঘাতে যেসব জেলা সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চল। ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র কারণে মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত বলবৎ রয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত বলবৎ আছে।
এছাড়া আরও জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪০ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। গাছ পড়ে, লাইন ছিঁড়ে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আবার দুর্ঘটনা এড়াতে অনেক এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। মোবাইল কোম্পানিগুলো বিকল্প উপায়ে নেটওয়ার্ক চালু রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আর রেমালের প্রভাবে এখন পর্যন্ত দুইজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ বিভাগের বিজ্ঞানী এস পি সিং সর্বশেষ বুলেটিনে জানান, উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র (ঘূর্ণিঝড়ের বডি) গত ৬ ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার গতিতে পূর্ব দিকে অগ্রসর এবং আরো শক্তি অর্জন করে ঘনীভূত হয়। ‘রিমাল’ প্রবল ঘূর্ণিঝড় রূপে মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ দিয়ে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া এবং পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের কাছাকাছি হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। রাতে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রমকালে ‘রিমালে’র গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার, যা দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার বেগে ১৩৫ কিলোমিটারে পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, উপকূলের সন্নিকটে এসে পৌঁছানোর সাথে সাথে ঘূর্ণিঝড়ের অবয়বের (বডি) গতিবেগ এবং ঝড়ের গতিবেগ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ তখন থেকে আরও ২ বা ৩ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলে পুরোপুরি আছড়ে পড়ার পথে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ আরও শক্তি অর্জন করায় এর গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ থেকে ১২০ কি.মি., যা দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৩৫ কিলোমিটারে উঠে। ‘রিমাল’ উত্তর দিকে গতিমুখ বজায় রেখে ধেয়ে যাচ্ছিল। ‘রিমালে’র সক্রিয় প্রভাবে গভীর ঘন মেঘমালা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে দেশের নদী বন্দরসমূহকে ৪ নম্বর নৌ মহাবিপদ সঙ্কেত দেখানো হচ্ছে। সারা দেশে নৌ চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র কারণে বঙ্গোপসাগর উপকূল উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম, মোংলা, কক্সবাজার-মাতারবাড়ী ও পায়রা সমুদ্র বন্দর কার্যক্রম শনিবার রাত থেকেই বন্ধ থাকে। তাছাড়া সারা দেশে নৌপথে যাত্রী ও মালামাল পরিবহণ, ফেরি সার্ভিস বন্ধ রয়েছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট উঠা-নামা গতকাল রবিবার (২৬ মে) সকাল থেকেই বন্ধ থাকলেও সোমবার (২৭ মে) তা আবার চালু হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা থেকে বন্ধ রাখা হয় কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল। চট্টগ্রাম থেকে নেয়াখালী, ভোলা, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দেশের অন্তত ১৪টি উপকূলীয় জেলার দশ লাখেরও বেশি উপকূলের নিম্নাঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষকে গত দু’দিনে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে অগণিত মানুষ দুঃসহ ও বিনিদ্র দিনাতিপাত করছে। আবার অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বসত ভিটার মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে।
এর আগে ‘রিমাল’ গতকাল রবিবার সকালে আরো ঘনীভূত ও শক্তি অর্জন করে ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে’ পরিণত হয়। এর পর প্রায় সারাদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার সঙ্গে উপকূলসহ দেশের অনেক জায়গায় গুমোট আবহাওয়া বিরাজ করে। দমকা থেকে ঝড়ো হিমেল হাওয়ার সাথে হালকা থেকে মাঝারি বর্ষণ, কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়। বিকাল থেকেই ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র অগ্রবর্তী অংশ বা সামনের ভাগ মোংলা, খেপুপাড়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূল হয়ে ভূমিতে প্রবেশ করে। তখন থেকেই ঝড়ের ঝাপটা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়।