Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ঘূর্ণিঝড়ের রূপ বদল

Icon

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ১৬:৫৯

ঘূর্ণিঝড়ের রূপ বদল

রূপ বদল করছে ঘূর্ণিঝড়। ছবি: সংগৃহীত

বদলে গেছে ঋতু-প্রকৃতি। তার সঙ্গে রূপ বদল করছে ঘূর্ণিঝড়ও। এর প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানা রিমালের মাধ্যমে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপকূলে আঘাত হানার পর থেকে প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করেছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে হঠাৎ কেন এত দীর্ঘস্থায়ী হলো রিমালের তাণ্ডব? আবহাওয়াবিদ ও বিশ্লেষকরাও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। 

গত প্রায় একশ বছরে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে গবেষণার রিপোর্টের উল্লেখ করে গবেষকরা বলছেন, ৬০-এর দশক পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়গুলো ভূমিতে আঘাত হানার পর ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত শক্তিক্ষয় হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই গতি প্রকৃতি বদলানোর কারণ, এখন ঘূর্ণিঝড় ভূমিতে আঘাতের পর শক্তিমাত্রা আর আগের মতো কমছে না। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ আরও কিছু কারণ আমলে নিয়ে এ বিষয়ে নতুন করে গবেষণার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

ভয়াল ঘূর্ণিঝড় আইলার চেয়েও বেশি সময় রিমালের প্রভাব ছিল উপকূলে। সাগরের বুকে যেমন বেশি সময় নিয়েছে, আবার স্থলভাগ ত্যাগেও সময় লেগেছে লম্বা। প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের অগ্রভাগ উপকূলে স্পর্শ থেকে শুরু করে নিম্নচাপ পর্যন্ত প্রায় ৫০ ঘণ্টা স্থলভাগে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এর প্রভাবে সারাদেশে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। ডুবেছে উপকূল, নেমে এসেছে বিপর্যয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, গত ২২ মে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ অবস্থা পেরিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় ২৫ মে সন্ধ্যায়। রবিবার সকালে ঘূর্ণিঝড়টি পরিণত হয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। ওই দিন বিকেলে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ স্থলভাগ স্পর্শ করে। ২৯ মে দুপুরের পর ঘূর্ণিঝড়টি নিম্নচাপ আকারে উপকূল অতিক্রম করে। এর আগে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানার পর ৩৪ ঘণ্টা ধরে দেশের ভূখণ্ডে প্রভাব ফেলেছিল। অন্যদিকে ১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিল আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টি ১৮ ঘণ্টা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ছিল। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ছিল ১৬ ঘণ্টা, ২০০৯ সালে আইলা ছিল ৩০ ঘণ্টা, ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ছিল ২৮ ঘণ্টা। আর ২০২২ সালে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব ছিল ১০ ঘণ্টা। এ হিসাবে ঘূর্ণিঝড় রিমাল বেশ ব্যতিক্রমী আচরণ করেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ উপকূলে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত হানে, সাধারণত দুই থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে তা স্থল নিম্নচাপ থেকে দুর্বল হয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ড অতিক্রম করে যায়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমাল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

তিনি বলেন, সাগরে প্রচুর তাপ তৈরি হচ্ছে। বাড়তি তাপ অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করে। সাগরে ১ ডিগ্রি তাপ বাড়লে বায়ুপ্রবাহ ৭ শতাংশ বেড়ে যায়। তাপ ধারণ করতে করতে ভেতরে শক্তি বেড়ে যায়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বৃষ্টির মাধ্যমে।

আজিজুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমাল সৃষ্টির সময় বঙ্গোপসাগরে ছিল অতিরিক্ত উষ্ণতা। এ সময়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকার কথা ২৬ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু দুই মাস ধরে সেখানে তাপমাত্রা ছিল ২৯ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়গুলোর চলার গতি (আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় ট্রান্স স্পিড) খুবই ধীর হবে। আমেরিকার জাতীয় আবহাওয়া সংস্থার বিজ্ঞানী জেমস খিন ১৯৪৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রমাণ পেয়েছেন, বিশ্বব্যাপী ঘূর্ণিঝড়ের চলার গতিবেগ গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে। আবার স্থলভাগে প্রবেশের পরে গতি কমেছে ২০ শতাংশ। চলার গতি কমে যাওয়ায় সমুদ্রের ওপর অবস্থান করার সময় অনেক বেশি পরিমাণে মেঘের সৃষ্টি করছে। স্থলভাগে পৌঁছানোর পরে সেই মেঘ থেকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল ২৬ মে সকাল পর্যন্ত ঘণ্টায় ১১ কিলোমিটার গতিতে এগিয়েছে। এর আগে ১৯৯০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঝড়গুলো ঘণ্টায় গড়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার গতিতে এগিয়েছে। সেই হিসাবে রিমাল তিন কিলোমিটার কম গতিতে এগিয়েছে।

ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশ বলেছেন, ঝড় নিয়ে অবশ্যই আরও গবেষণা করা উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ ঘূর্ণিঝড়গুলোর পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ঝড়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।

আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, আবহাওয়া ও জলবায়ুতে পরিবর্তন আসছে। এসব বদল আমাদের এ অঞ্চলে দুর্যোগের চরিত্রে পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এই ঝড় থেকে আমরা সেই শিক্ষাই পেলাম।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫