Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

হারিয়ে গেল চিত্রা মহল

Icon

সুজিত সজীব

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৪, ১৮:১৩

হারিয়ে গেল চিত্রা মহল

পুরাতন চিত্রা মহল। ছবি: সংগৃহীত

অনেক সমস্যা ছিল। ছিল আর্থিক টানাপড়েন। তাতে নিয়মিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়া ছিল মুশকিল। তবু পরিস্থিতি বদলে চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু তাতেও হলো না শেষ রক্ষা। ভেঙে ফেলতে হলো চিত্রা মহল সিনেমা হল। আর চিত্রার গেটে কখনো ঝুলবে না হাউসফুল লেখা সাইনবোর্ড। গত ঈদুল ফিতরের আগে চিত্রা মহলকে ভেঙে বহুতল মার্কেট নির্মাণের জন্য কাজ শুরু হয়েছে। 

পুরান ঢাকার বিখ্যাত সিনেমা হল চিত্রা মহলের এমন পরিণতি দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি অনেকে। তাদের একজন মালিটোলার মানিক চান। চিত্রা মহলের সামনে পাকিস্তান আমল থেকে বাদাম বিক্রি করেন। কিন্তু এখানে আর কখনো মর্নিং, ম্যাটিনি, ইভিনিং অথবা নাইট শোয়ে মানুষের ভিড় হবে না। বিক্রি হবে না মানিক চানের বাদাম-স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মানিক চানের চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি বলেন, এখানে রাস্তা আছিল না, খাল আছিল। আমি মালিটোলা থেইকা নৌকায় খাল পার হইয়া এখানে আইতাম। আর তখন টিকিট কাটার লাইন হল গেট থেইকা জিন্দাবাহারের মুখে ঠেকত! ১৩ আনা দিয়ে রিয়াল স্টলে উর্দু বই (চলচ্চিত্র) দেখছিলাম। মাগার অখন বাংলা বই আর চলে না, আর আজ... 

শুধু মানিক চান নয়, পান-সিগারেট বিক্রেতা রফিক, ছোলাবুট বিক্রেতা নাজির, টিকিট কালোবাজারি ফিরোজ, হলের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এলাকার মানুষ, সবার মনেই বিষাদের সুর, চিত্রা মহল নেই। 

মালিকপক্ষ অবশ্য বলছে, মার্কেটের ভেতর ছোট পরিসরে চিত্রা মহলকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন। কিন্তু মানিক চান জানেন, এটা নিছকই একটি সান্ত্বনা বাণী। কারণ লায়ন, স্টার, মুন, শাবিস্তান, নাজ, গুলিস্তান, মানসী, রূপমহল সব সিনেমা হলের ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেসব আর ফিরে আসেনি।

গুলিস্তান থেকে সদরঘাট যেতে ইংলিশ রোডে চিত্রা মহলের অবস্থান। ঢাকার প্রথম দিকের ১০টি সিনেমা হলের অন্যতম এটি। পাকিস্তান আমলে এই হলের নাম ছিল নাগর মহল। তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী নাগর পোদ্দার ছিলেন মালিক। সে সময় হিন্দি, উর্দু সিনেমা চলত। মুক্তিযুদ্ধের সময় নাগর পোদ্দার ভারতে চলে যান। 

মুক্তিযুদ্ধের পর এটি দীর্ঘদিন শত্রু সম্পত্তি হিসেবের সরকারের তত্ত্বাবধানে ছিল। হলটি বিক্রির কথা উঠলে, সামনে খাল, রাস্তা নেই; তাই কেউ আগ্রহী ছিল না। তখন কাজী জহির এগিয়ে আসেন। তিনি তার স্ত্রী-অভিনেত্রী চিত্রা সিনহার নামে হলের নামকরণ করেন। 

১৯৮৩ সালে চিত্রার প্রথম দিন থেকে শেষ পর্যন্ত এখানে কাজ করেছেন আবদুল করিম। তিনি জানান, প্রথম দিন এখানে দেখানো হয় খান আতাউর রহমানের ‘আরশি নগর’ ছবিটি। আর তখন কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করা কঠিন ছিল। যে কোনো ছবির টিকিট ব্ল্যাকে বিক্রি হতো। 

চিত্রা মহলে ছিল ঐতিহ্যের ছোঁয়া। পুরনো নকশার দোতলা ভবন। দুপাশে দুটি ছোট বারান্দা। মূল দরজার ওপরে প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা। নিচতলায় ঢুকেই টিকিট কাউন্টার। তিন ক্যাটাগরিতে ছবি দেখার ব্যবস্থা ছিল-সাগর, ঝিনুক, শাপলা। কাজী জহিরের তিন সন্তানের নামে এই তিন ক্যাটাগরি। 

কাজী জহিরের ভাতিজা ইকবাল ইউসুফ এখন হলটির দায়িত্বে। তিনি জানান, সরকার সিনেমা হলগুলো বাঁচাতে ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু আমরা চাই প্রণোদনা বা অনুদান। ব্যবসা নেই। তাই সুদ দিতে পারব না। তবে আস্তে আস্তে মূলধন ফেরত দিতে চাই। কিন্তু তাতে ব্যাংক রাজি না। তাই এখন মার্কেট করছি। 

তিনি বলেন, আমার চাচা (কাজী জহির) ছবির বিষয়ে ছিলেন খুব খুঁতখুঁতে। তিনি সব সময় সুস্থ ধারার ছবির পক্ষে ছিলেন। হুজুগের সঙ্গে তাল মেলাননি। চাচা বলতেন, আমার নায়ক মারামারি জানেন না, আমার নায়িকা লাফ দিয়ে নাচতে জানে না।

নতুন ভবনে চিত্রা মহল স্থান পাবে কিনা-এমন প্রশ্নে ইকবাল ইউসুফ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মাথা নিচু করে বসে থাকেন। অনেকক্ষণ তার মুখে কোনো কথা নেই। তারপর একসময় নীরবতা ভেঙে বললেন, মূলত এত লস দিয়েও চাচির (চিত্রা জহির) অনুপ্রেরণায় আমরা এতদিন হলটি চালিয়েছি। আর... 

কথাটা শেষ করতে পারলেন না ইকবাল ইউসুফ, অঝোর ধারায় তার চোখে নামল জলের ধারা...

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫