
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। ছবি: সংগৃহীত
‘কালো সাহেবের মেয়ে ইশকুল পালিয়ে ধরতে তোমার দুটো হাত-
কত মার খেয়েছি মুখ বুজে সয়েছি অন্যায় কত অপবাদ’
অঞ্জন দত্তের গাওয়া এই গানের ‘কালো সাহেব’ একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কারা? ইউরোপীয় পিতা ও ভারতীয় উপমহাদেশীয় মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তানরা ঐতিহাসিকভাবে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় নামে পরিচিত। যদিও পর্তুগিজরাই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে এবং গোয়ায় স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। এদের একটি অংশ স্থানীয়দের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলে তাদের সন্তান ও পরবর্তী বংশধররাও ‘পর্তুগিজ গোয়ানিজ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’ হিসেবে পরিচিত হন। গোয়ানিজ অ্যাংলোরা ধীরে ধীরে সারা ভারতে ছড়িয়ে যায়। হাফ রেড, বাদামি ও ফর্সা রঙের অ্যাংলোরা পোশাকে, চলন-বলনে ছিল পুরোদস্তর ইউরোপীয়। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের বসবাস ছিল ঢাকায়। যদিও দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতার কারণে এখন তারা সংখ্যায় খুবই কম।
বাংলাদেশে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বর্তমান অবস্থা জানার আগ্রহ অনেক দিনের। যা খানিকটা মিটল পুরান ঢাকার রোকনপুরের বাসিন্দা পর্তুগিজ গোয়ানিজ বংশোদ্ভূত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মাইকেল ডি’রেঞ্জোকে পেয়ে। যদিও ঢাকায় এ সম্প্রদায়ের মানুষ এখন খুব একটা দেখা যায় না। মাইকেল ডি’রেঞ্জো বলেন, “দেশভাগের পর ঢাকার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারগুলোর বেশিরভাগ রেলওয়েতে কর্মরত ছিল। চাকরি সূত্রে দেশভাগের সময় ভারত থেকে অনেকেই এদিকে চলে আসেন। আবার অনেকেই তখন বিদেশে চলে গেছেন। যারা সে সময় বিদেশে গেছেন, দেশভাগের পর তারা মনে করেছেন এখানে আমাদের আর কেউ নেই। হয়তো তারা নিজেদের অনিরাপদ বোধ করেছেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের এই অনুভূতিটা ছিল না যে, এ মাটিতেই তাদের জন্ম। ফলে ১৯৪৭-এর পর বহু অ্যাংলো এ দেশে চলে এলেও ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে তারা দেশ ছাড়তে শুরু করে।”
তিনি বলেন, ‘তখন খুব সম্ভবত ১৯৫৯ সাল, আমাদের বাড়ি থেকেই একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার, মি. ওয়েকফিল্ডকে তার স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ চলে যেতে দেখলাম। আইরিশ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এ পরিবারটি ইংল্যান্ড চলে যাওয়ার আগে আমাদের বাড়িতে বিশ-পঁচিশ দিনের জন্য ভাড়া থেকেছিল।’
সত্তরোর্ধ্ব মাইকেল ডি’রেঞ্জো বছর বিশেক আগে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর হন, তার বর্তমান নাম মোহাম্মদ আলী মাইকেল। কিন্তু তিনি তার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিচয়টি গোপন করেন না এবং করতে চান না। তার দেখা পুরান ঢাকার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারগুলো সম্পর্কে বলেছেন সাবলীলভাবে। তাদের ইতিহাস বিশদভাবে লেখার আগ্রহও প্রকাশ করেন তিনি। জানালেন, “সত্তরের দশকের শুরুর দিকে আমাদের পাশের বাসার নিচতলায় থাকত ‘জনস্টোন ফ্যামিলি’, দোতলায় থাকত ‘হফ্ ফ্যামিলি’। এ দুটো পরিবারে মধ্যে হফ্ ফ্যামিলি দেশ ছেড়ে যায়নি, তাদের সকলেই এ দেশে মৃত্যুবরণ করেছে। আমাদের পাড়ায় মি. জনসন ও মিসেস জনসন দম্পতি থাকতেন। মি. জনসন সত্তরের দশকের বিখ্যাত ইংরেজি পত্রিকা মর্নিং নিউজে চাকরি করতেন। মিসেস জনসন কাকরাইলের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আমাদের রোকনপুরেই থাকতেন মি. পামা ও মিসেস পামা। তাদের সন্তান ফ্রান্সিস পামাকে এদেশের ট্রাভেলিং এজেন্সির জনক বলা হয়। হল্যান্ডের কেএলএম এয়ারলাইন্সের এ দেশীয় শাখায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। কেএলএম এখান থেকে শাখা তুলে নিলে ফ্রান্সিস পামা আমেরিকায় চলে যান।
নগর ভবনের কাছে যখন রেলওয়ে কলোনিগুলো ছিল, সেখানেও কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার থাকত। মাইকেল বলেন, ‘মি. সার্জেন্ট রেলওয়ের অনেক উঁচু পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি ফ্যামিলিসহ যখন ট্রেনে করে কোথাও যেতেন, তাদের জন্য একটি বগি বরাদ্দ থাকত’।
ঢাকার অধিকাংশ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ইংরেজিতে কথা বলতেন, প্রয়োজন হলে উর্দু ও হিন্দি ব্যবহার করতেন। অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে অ্যাংলোরা বেশ উদারই ছিল। কেউ এক আনা সাহায্য চাইলে তারা চার আনা দিত। পুরান ঢাকার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারগুলো সম্পর্কে এভাবে মাইকেল অনর্গল বলে গেলেন। তার আক্ষেপ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা যে এ দেশে আছে বা এসেছে তা এ প্রজন্মের ছেলেপেলেরা জানেই না। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বলতে কী বোঝায় তাও জানে না।
ইতিহাস গবেষক হাসেম সূফী বলেন, পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই মাইগ্রেশন হয়ে আসছে। ঢাকাতে এক হাজার বছর আগে বসতি প্রক্রিয়া শুরু হয়, স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন জাতি এখানে আসবেই। পর্তুগিজরা ভারতে এসেছে পঞ্চদশ শতকে, ঢাকায় এসেছে ষোড়শ শতকে। ব্রিটিশরা যখন টেলিগ্রাফ ও রেলওয়ে চালু করল-তখন তারা রেলওয়ের পোস্টমাষ্টার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কর্মচারী, টেলিগ্রাম মাস্টার, স্কুল শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশায় ঢাকায় আসতে শুরু করল। বাহাদুরশাহ পার্কের আশপাশের মহল্লাগুলো অর্থাৎ রোকনপুর, লক্ষ্মীবাজার ইত্যাদি এলাকায় তারা থাকতে শুরু করে।