Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

গ্রাফিতি এ প্রজন্মের প্রতীকী ভাষা

Icon

এহসান হায়দার

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১৯:০১

গ্রাফিতি এ প্রজন্মের প্রতীকী ভাষা

গ্রাফিতি। ছবি: সংগৃহীত

চিত্র কথা বলে, পথের দেয়ালচিত্র আরও বেশি নাড়া দেয় মানুষকে-ভাবায়, পথ চলতি অনেক মানুষ হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়, কী লেখা হয়েছে দেয়ালে-কী আঁকা হয়েছে দেয়ালে-এ যেন এক ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ জিজ্ঞাসাকেন্দ্র। ঢাকা শহরের বিভিন্ন দেয়ালে গত কয়েক বছরে চোখে পড়ে ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’, ‘সুবোধ কবে হবে ভোর?’-এই লেখার সঙ্গে একটি মানুষের ছাপচিত্র একটি সূর্য আর একটি খাঁচা, কখনো সেই খাঁচা বন্ধ থাকে কখনো সেই খাঁচা খোলা! 

আশ্চর্য আর কিছু বলা হয়নি, এই বাণীগুলো কি প্রশ্ন তৈরি করে মনে? সরকার ভালো নয়, আয়নাঘরে যেতে হবে, কথা কম বল-এমন কিছু কি? এরপর বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যার বিচার চেয়েও হয়েছিল এমন অনেক দেয়ালচিত্র, যা আজও বুয়েটের হলগুলোর দেয়ালে পাওয়া যায় দেখতে-‘justice for abrar’, ‘পারবেন আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে’, ‘হ্কো প্রতিবাদ’সহ আরও অনেক চিত্র-কথা। এমন চিত্রকে আমরা বলে থাকি গ্রাফিতি, যা বিমূর্ত এবং বিরুদ্ধভাষণের চিন্তাকে উসকে দেয়। ‘গ্রাফিতি’ ইতালিয়ান শব্দ ‘Grafitiato’ থেকে আসে, যার অর্থ ‘খচিত’, আবার শিল্পবোদ্ধারা বলেন, কাউন্টার কালচার। বাস্তব কথা হলো গ্রাফিতি অনুমতির ধার না ধারা শিল্প, যা বিকৃত মনে হতে পারে, যা ক্ষুরধার তীক্ষ্ণ ফলার মতো, মানস হৃদয়ে সাহস জোগায়, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার, হাস্যরস বা ঠাট্টার মধ্য দিয়ে চেতনা জাগ্রত করার শিল্প। জনমনে নতুন চিন্তার ধারণা সৃষ্টির অবিদ্যায়তনিক শৈল্পিক অ-শিল্প। যা প্রথানুযায়ী শিল্পমাধ্যম না হয়েও কখনো কখনো অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে বিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে। 

ফলে সম্প্রতি পৃথিবীজুড়ে এই মাধ্যমটির কদর অনেক বেড়েছে। জেন মিচেল বাস্কুইটের গ্রাফিতি জনমনে অধিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। এমনকি তার আঁকা একটি গ্রাফিতি ১০ কোটি মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছিল। 

গ্রাফিতি শব্দটি শিলালিপি, চিত্র অঙ্কন এবং এই ধরনের শিল্প বোঝায়। প্রাচীন সমাধি বা ধ্বংসাবশেষের দেয়ালের মধ্যেও এগুলো পাওয়া যায়। গ্রিক নগরী এফেসাসেই আধুনিক গ্রাফিতির উদ্ভব। সেখানে গ্রাফিতি পতিতাবৃত্তির বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হতো একসময়। বর্তমান সমাজের চেয়ে প্রাচীন গ্রাফিতিগুলো আরও বেশি অর্থপূর্ণ এবং ভিন্ন ভিন্ন ধারায় সৃষ্টি করা হতো। প্রাচীন গ্রাফিতিগুলো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটাত। সব সময় বঞ্চনার শিকার হওয়া মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন এই মাধ্যমের। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এর চেয়ে তীব্র আর কিছু নেই।      

তাই হঠাৎ ঘর থেকে বের হয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভেতর ঢুকতেই ‘হল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’ কবীর সুমনের গানের লিরিক্সকে কিঞ্চিৎ বদলে এমন লেখা চমক দিয়ে কালো অক্ষরে আটকে যায় চোখ, এই লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসির কার্যালয়ের দেয়ালে রয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নস্যাৎ করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক হল ছাড়বার নির্দেশ দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন-সেই নির্দেশে যে অন্যায়, সেই অন্যায়ের চিত্র ফুটিয়েছে সময়ের সাহসী সন্তানেরা। এই লেখাটি যারা লিখেছে এরা কেউ শিল্পী নন, তবুও এরা লিখে রেখেছে ‘আমি মেট্রোরেল হতে চেয়েছিলাম, খোদা আমাকে ছাত্র বানালো’ এমন আশ্চর্যজনক স্যাটায়ার তির্যক হয়ে বেঁধে যেন শাসক দলের বুকে। তারা সইতে পারে না, সরকারের অতবড় উন্নয়নকেও ভয় পায় না, রক্ত চোখ দেখায়, ব্যঙ্গ করে। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মের আহ্বানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বৈরসরকার-বিরোধী এমন অনেক চিত্র দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হয়-লেখা হয়, যা হয়ে ওঠে আন্দোলনের ভাষা, প্রতিবাদের ভাষা। দমন-নিপীড়নের সমস্ত কৌশল যেমন এ ক্ষেত্রে বাদ রাখেনি সরকারপন্থিরা, ঠিক তেমন করেই কখনো যে শিক্ষার্থী আঁকেনি ছবি, কখনো ধরেনি পেইন্ট স্প্রে কিংবা রঙ-তুলি-তারাও চিত্রে কথা বলেছে এভাবেই-‘ছিঃ ছিঃ হাসিনা’, ‘খুনি খুনি’, ‘আমার ভাই মরলো কেন?’, ‘Hasina  Hasina you can’t hide, we charge you with genocide’, ‘স্বৈরাচারের হয়নি পতন, মুক্তিযুদ্ধ হয়নি শেষ, গর্জে ওঠো বীর জনতা, গর্জে ওঠো বাংলাদেশ’, ‘গেরিলা বসন্তে আমরাই বুনোফুল’, ‘আসছে ফাগুনে আমরা দ্বিগুণ হবো’ এমন অনেক চেনা-অচেনা সব বাক্য এ প্রজন্মের তারুণ্য শেখালো দেশের মানুষকে। 

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মায়ের মুখের শোকাহত রংপুইরা ভাষাও দেয়ালচিত্রে বাদ যায়নি, ‘হামার বেটাক মারলু কেনে?’ আবার দেখা মেলে ‘ছাত্র যদি ভয় পাইতো বন্দুকের গুলি, উর্দু থাকতো রাষ্ট্রভাষা, উর্দু থাকতো বুলি’, ‘দেশ স্বাধীন হলে আমরা আবার ছাদে উঠব’, ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’, ‘লোহার টুপি মানুষের মগজ খায়’, ‘মেধা শহীদ’ প্রভৃতি।

‘কোন দেশি রাখাল তুমি, উড়াও কেনে ঘুড়ি?/আমার ঘুড়ি অনেক বড়, উড়বে আকাশ জুড়ি/নীলচে আকাশ আমার-নেই সীমানা, ভাগ করো না তুমি/ছোট লোকের-নয়কো আকাশ নয়কো মাতৃভূমি...’   তারুণ্যদীপ্ত শিক্ষার্থীরা ছোট বলেই এমন হেলা করে বুঝি হুঙ্কার দিয়েছিল স্বৈরশক্তি, যে শক্তি আজ পরাজিত হয়েছে নাম না জানা এ প্রজন্মের অসংখ্য শিক্ষার্থীর কাছে, পালিয়েছে দূরে তেপান্তরে রূপকথার গল্পের মতো।  

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫