
এ যুগের প্রীতিলতারা। ছবি: সংগৃহীত
সেই মেয়েটি... যে মৃত্যুর ভয়কে তুচ্ছ করে অসম সাহসিকতায় একা পুলিশের গাড়ি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, ভাইয়ের গ্রেপ্তার ঠেকাতে পুলিশি ক্ষমতার বিরুদ্ধে বাঘিনীর ভূমিকা নিয়েছিলেন, ভাইকে ছাড়িয়ে নিতে শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন। বা ওই শিক্ষিকা যিনি প্রিয় ছাত্রকে ধরে রেখেছিলেন তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে-বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে এমন ছবি ও ভিডিও সয়লাব ছিল।
সমাজে যত পরিবর্তন এসেছে, সবখানে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। হেনস্তার শিকার হয়েও নারীরা দমে যাননি, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ৫২, ৬৯, ৭১ এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আন্দোলন শুরু হয় জুন মাসে আর তীব্রতা পেতে থাকে জুলাইয়ের শুরুতে। এ আন্দোলনের প্রথমদিকে ছাত্রীদের উপস্থিতি কম দেখা গেলেও পরে দলে দলে তাদের মিছিল সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে। মেয়েরা ‘নারী কোটা চাই না’-এমন স্লোগান সংবলিত পোস্টার লিখে মিছিলে যোগ দিয়েছেন। সভাগুলোতে ছাত্রীদের বক্তব্যেও বারবার উঠে এসেছে তারা নিজেদের যোগ্যতায় সামনে এগিয়ে যেতে চান, বিশেষ কোনো সুবিধা চান না। দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। এ আন্দোলনে শুধু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নয়, শিক্ষিকা, পেশাজীবী, গৃহিণী, মা-বিভিন্ন পরিচয়ে নারীরা কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হয়েছেন। মায়েরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে খাবার দিয়েছেন, পানি দিয়েছেন এবং আক্রমণ থেকে সন্তানকে বাঁচাতে বর্ম হয়েছেন।
গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ দিনও সামনের সারিতে ছিলেন নারী শিক্ষার্থীরা এবং প্রথমে তাদের ওপরই হামলার ঘটনা ঘটে। ১৬ জুলাই রাতে হলের তালা ভেঙে প্রথম বেরিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীরা। তাদের স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। রোকেয়া হলের ছাত্রীদের এ প্রতিবাদের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর একে একে অন্যান্য হল থেকে ছাত্ররাও বের হতে থাকেন। এ রাতেই অন্যান্য হল থেকেও ছাত্রীরা স্লোগান দিতে এসে জড়ো হন রাজু ভাস্কর্যের সামনে। আর পরে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা হৃদি এ আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক। তিনি বলেন, ‘শুরু থেকে ছাত্রী উপস্থিতি ততটা ছিল না। যারা আসতে চায় আন্দোলনে কিন্তু বিভিন্ন বাধার কারণে আসতে পারেনি, হলে হলে প্রচার চালিয়ে সেই বাধাগুলো পর্যালোচনা করা হয়। তাদেরকে সাহস দেওয়া হয়। হলের গ্রুপগুলোতে আন্দোলনের কর্মসূচি এবং কখন বের হতে হবে এগুলো যখন জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে সেখানে অংশগ্রহণ করছেন।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারীদের এ অংশগ্রহণ আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিককে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানা বলেন, ‘নারীরা এর আগেও বিভিন্ন আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা দেখিয়েছে। এ আন্দোলনে আবারও বুঝিয়ে দিয়েছে নারী আর অনগ্রসর নয়, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী। কোনো করুণা দিয়ে নয় বরং নিজের যোগ্যতা দিয়ে সমান প্রতিযোগিতা করে সামনে এগিয়ে যেতে চায়।’
তিনি আরও বলেন, এ আন্দোলনে শুধু ছাত্রীরা নয়, মায়েরা যেভাবে ভূমিকা পালন করেছেন তা সবাইকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু এ আন্দোলনে আমরা নারীর প্রতি যে নৃশংসতা দেখেছি, যেভাবে নির্বিচারে শিক্ষার্থীসহ শিশু ও সাধারণ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তা দেশের ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি।
স্বাভাবিকভাবে দেখা যায়, যে কোনো হামলা, যে কোনো নিপীড়নের ক্ষেত্রে নারীকে টার্গেট করা হয়। এমনকি আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকা শিক্ষিকাকেও টার্গেট করা হয়েছে। আন্দোলনের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলাকারীদের হাতে ‘যৌন নিপীড়নের শিকার’ এবং গ্যাস লাইট দিয়ে মুখমণ্ডল পুড়িয়ে দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের এক নারী সাংবাদিকের। এ সময় তার সঙ্গে আরও দুই নারী সহকর্মী ছিলেন। তারাও মারধরের শিকার হন। তারা বলেন, সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর আন্দোলনকারীদের একটি অংশ তাদের ওপর হামলা চালায়।
এবারের আন্দোলনে নারীদের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে দেখা গেছে। নারী এখন অনেক এগিয়ে। সে আর কারও বোঝা নয়, বরং অন্যের সাহস হতে পারে, বিপদে সমানভাবে পাশে দাঁড়াতে পারে; সেটাই এ আন্দোলনে প্রমাণ হয়েছে। পুলিশের গাড়ির সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি নুসরাত নুর। আর পুলিশ যে ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করেছিল, তিনি নুসরাতের ভাই নুর হাসান। ফেসবুকে ভাই-বোনের এই ছবি পোস্ট করে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘মেয়েটি এ যুগের প্রীতিলতা। এমন বিপ্লবী মেয়ে কেবল বাংলাদেশেই জন্মগ্রহণ করে। ভাইকে গ্রেপ্তারের হাত থেকে বাঁচাতে প্রীতিলতার মতো করে পুলিশের গাড়ির সামনে যেন আত্মাহুতি দিতেই দাঁড়িয়েছিলেন। এমন সাহসী বোন ঘরে ঘরে দরকার।’