
গ্রাফিতি। ছবি: সংগৃহীত
গ্রাফিতির জনক ফরাসি চিত্রশিল্পী ব্লেক লে রাত প্যারিসের দেয়ালে দেয়ালে এঁকেছিলেন নানা অসঙ্গতি, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ আর সামনের দিনের আশার বাণী। এসব দেয়াল ছবি দেখে নগরের মানুষরা কখনো উদ্বুদ্ধ হয়েছেন লড়াইয়ে, কখনো হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন আবার কখনো আশায় বুক বেঁধেছেন। এভাবে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে গ্রাফিতি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে দেশের আপামর ছাত্র-জনতা করেছেন গ্রাফিতির বিপ্লব। দেয়ালে দেয়ালে মানুষের ক্ষোভ আর যন্ত্রণার গল্প, মানুষ চায় নতুন দেশ গড়তে, চায় নতুন সময়কে আলিঙ্গন করতে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে এবার ২৯ জুলাই প্রথম সারা দেশে ছেলে-মেয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেয়াল লিখন আর গ্রাফিতির কাজ শুরু করেছিল। ওই গ্রাফিতিগুলো আঁকা হয়েছিল এক বিশেষ সময়ে, বিশেষ অবস্থায়। বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি হতে পারে সেই আশঙ্কার মধ্যেই, যাদের আর্ট নিয়ে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না, চারুকলায় গিয়ে আঁকা শেখা হয়নি, তারাও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ লিখে এসেছে দেয়ালে দেয়ালে। এই গ্রাফিতিগুলোর মূল্য অপরিসীম। কিন্তু স্বৈরাচার আর গণহত্যার বিপক্ষে সেসব প্রতিবাদী, অগ্নিময় গ্রাফিতি আর দেয়াল লিখনগুলো, গণ-অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহের মধ্যে মুছে ফেলে নতুন করে লেখা হয়েছে। কিন্তু খুব কি বদলে গেছে গ্রাফিতির ভাষাগুলো? চোখ আমাদের সেদিকেই।
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখনো গ্রাফিতি আঁকছেন শত শত শিক্ষার্থী। আর এই গ্রাফিতিগুলোতে অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সমাজের-রাষ্ট্রের সংস্কার, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা, স্বৈরতন্ত্রের অবসান, বাকস্বাধীনতা, সম-অধিকার থেকে শুরু করে এসেছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর প্রতিরোধের অগ্নিময় উক্তি।
স্কুলের ছোট বাচ্চারা তাদের কাঁচা হাতে আঁকছে বাংলাদেশের মানচিত্র, আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, তাদের চোখে দেখা নতুন বাংলাদেশকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড এলাকায় অর্থনীতি বিভাগের সায়মা বিনতে কুদ্দুসের নেতৃত্বে গ্রাফিতি আঁকছিলেন ইশরাত জাহান,আবরার হাফিজসহ অনেকে। তারা বললেন, ‘আমাদের দাবিগুলো যেন হারিয়ে না যায়, এ জন্যই দেয়ালে লিখে রাখা হচ্ছে।’ অনেকে দিনপঞ্জিকার মতো করে গ্রাফিতি এঁকেছেন। জিগাতলার ডেসকো কার্যালয়ের সামনের দেয়ালে এমন একটি গ্রাফিতিতে বিভিন্ন তারিখের ঘরে কোনোটিতে আছেন আবু সাঈদ, কোনো তারিখে মুগ্ধ, কোনো দিন ‘বাংলা ব্লকড’ উঠে এসেছে।
সাতমসজিদ রোডের গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের প্রাচীরে একটি গ্রাফিতিতে দিনপঞ্জিকার গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলো আঁকা হয়েছে লাল রঙের হরফে। এই লাল রঙের দিনগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইতিহাসে, গণমানুষের স্মৃতিতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি, সাহস ও প্রেরণা হয়ে।
যে যেভাবে এ বিপ্লবের অংশ হয়েছে, তার যন্ত্রণা আর ক্ষোভের বহির্প্রকাশ হলো বিপ্লবের একটি অংশ। যাদের দীর্ঘকাল ধরে নীরব থাকতে হয়েছিল তাদের দুঃখ, ক্ষোভ সেখানে প্রকাশ পায়। তাই বিপ্লবের দেয়াল লিখন খুব বেশি পরিশুদ্ধ হবে এমনটা ভাবা উচিত নয়। গ্রাফিতি ও স্লোগান যতটা তীব্র ভাষার হোক না কেন, এটি আমাদের ইতিহাসের অংশ। এগুলো বিপ্লবের ভাষা। তাই এগুলো সংরক্ষণ করা উচিত।
বার্লিনের দেয়াল এখনো বিভক্ত শহরের বেষ্টনী হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কায়রোতে তাহরির স্কয়ারের গ্রাফিতি স্বাধীনতার জন্য মানুষের লড়াইয়ের স্মারক হিসেবে রয়ে গেছে। আমরা মিশরে এমন প্রতিক্রিয়া দেখেছি, কেননা সেখানে এক বছর পরে বিপ্লবী দেয়ালগুলো মুছে ফেলা হয়েছিল।
আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে যে, আমরা কী মুছে ফেলতে চাইছি? কঠিন সব শব্দ? আমাদের অস্বস্তি? এমন সত্য যা আমাদের জন্য সুখকর ছিল না?