
প্রতীকী ছবি
দেশে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রস্তাব অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের সংবিধানে এ ধরনের কোনো বিধান নেই। সংবিধানে কেবল নির্বাচিত সরকারের কথাই বলা আছে। নির্বাচিত সরকারের বিকল্প হিসেবে আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি থাকলেও উচ্চ আদালত তাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। পরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ২০০৯-১৪ মেয়াদের সময় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বাতিল হয়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান-সংবলিত বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আইন, ১৯৯৬ সালে পাস হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ ভাগে ‘২ক পরিচ্ছেদ : নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নামে নতুন পরিচ্ছেদ যোগ হয়। এতে ৫৮ক, ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ও ৫৮ঙ নামে নতুন অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ এর অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ কার্যক্রম ও মেয়াদকালসহ বিস্তারিত বিষয়ে উল্লেখ ছিল। পরে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করার প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালে ৩০ জুন এই ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ে পরবর্তী দুই মেয়াদে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে বাইরে রাখার কথা বলা হয়। যদিও রায়ের ওই পরামর্শটি অনুসরণ না করেই ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া রায়ের দেড় মাসের মাথায় ওই বছরই ৩০ জুন সংবিধান সংশোধন করে পদ্ধতিটি একেবারেই বাতিল করে দেওয়া হয়। সাধারণত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলেও, এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছিল পরের বছর ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতায় থাকা সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ওই সরকারই বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
কিন্তু নির্বাচন ছাড়াই হুট করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটায় বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি ওঠে। তবে এ ব্যাপারে সংবিধানে কিছুই বলা না থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঘিরে আইনি একধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ সময়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অনেক সময় অনেক কিছু করতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি বিধান করা যেতেই পারে। তবে এ ব্যাপারে অবশ্যই ভবিষ্যতে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী সরকারের প্রধান হওয়ার বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন।
গণ-অভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম সংসদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে জন্য বিচারপতি আহমদকে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এরপর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই বিষয়টি বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পঞ্চম সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হয়। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়টিতেও আইনি কোনো জটিলতা দেখছেন না সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।