
প্রায় দুই যুগ ধরে লোকসান গুনছে রেল। ছবি: সংগৃহীত
প্রায় দুই যুগ ধরে লোকসান গুনছে রেল। লোকসানের মাত্রা এতোটাই বেড়েছে যে, আয়ের বিপরীতে ব্যয় কমাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরে রেলে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি এবং লোকসান হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ রেলকে প্রতিবছর গড়ে লোকসান গুনতে হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বর্তমানে রেলের আয়ের চেয়ে ব্যয় আড়াই গুণের বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলওয়ের লোকসানের অন্যতম কারণ দুর্নীতি ও অপরিকল্পিত ব্যয়। এ ছাড়া বিনা টিকিটে ভ্রমণ এবং প্রায় সব ট্রেনে অর্ধেকের কম কোচ (বগি) নিয়ে চলাচলের কারণে লোকসানের পরিমাণ বেড়েছে। অর্থাৎ শতভাগ কোচ নিয়ে যদি ট্রেন চলত এবং জনপ্রিয় রুটে যদি ট্রেনের সংখ্যা বাড়ত, তাহলে অপারেটিং রেশিও কমে যেত। পাশাপাশি অপারেশন বাড়াতে হবে পণ্য পরিবহনে। এতে রেলের আয় বাড়বে।
আরও জানা গেছে, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের রেল বিভাগে দুর্নীতি অনেক কম। তারা অতিরিক্ত ব্যয় খুব কমই করে। ভারতীয় রেলে এক দশক ধরে অপারেটিং রেশিও ৯৫-৯৮ শতাংশের ঘরে। ফলে সে দেশে রেলওয়ে লাভজনক অবস্থায় আছে। বর্তমানে ১ টাকা আয় করতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৮ পয়সা। অন্যদিকে ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশে রেলওয়ের অপারেটিং রেশিও বেড়েই চলছে। ফলে বাড়ছে লোকসান। বর্তমানে ১ টাকা আয় করতে খরচ করতে হচ্ছে ২ টাকা ৫৮ পয়সা।
রেলওয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে রেলের সবচেয়ে ভালো অপারেটিং রেশিও ছিল ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে, ৯৫ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে প্রতি ১ টাকা আয় করতে রেলের ব্যয় হয়েছিল ৯৫ দশমিক ৯ পয়সা। এরপর থেকে রেলের অপারেটিং রেশিও কেবল বেড়েই চলেছে।
রেলওয়ের গত ১৫ বছরর ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময়ে রেলের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ৮৯টি প্রকল্পে খরচ হয়েছে ২১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। চলমান আছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকার ৩২টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৬৬ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। সমাপ্ত ও চলমান প্রকল্প মিলিয়ে গত ১৫ বছরে রেলওয়ের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে মোট ৮৭ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা।
রেলওয়ের তথ্য বলছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর সংস্থাটির অপারেটিং রেশিও ছিল ১৫৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে ১ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ১ টাকা ৫৯ পয়সা। অপারেটিং রেশিও নিয়ে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের তথ্য প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এতে দেখা যায়, ওই অর্থবছরে অপারেটিং রেশিও বেড়ে ২৫৮ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে ১ টাকা আয় করতে ব্যয় হয়েছে ২ টাকা ৫৮ পয়সা। ওই সময় সব মিলিয়ে রেলের লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) নাজমুল ইসলাম বলেন, নতুন সরকার এসেছে। সবাই এখন কাজ করছে। এখন আমাদের ব্যয় সংকোচনের দিকে নজর দিতে হবে। দেখেন, আয়ের সীমা কিন্তু সীমিত। যেমন একটি ট্রেন থেকে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা আয় করতে পারবেন। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আমাদের এমন প্রকল্প হাতে নিতে হবে, যেন না করলেই নয়। তবেই রেল লোকসান থেকে বের হবে।
এদিকে রেলের লোকসান নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেলকে যদি দুর্নীতিমুক্ত করা যায়, অপরিকল্পিত ব্যয় বন্ধ করা যায়, তাহলে লোকসান অনেকাংশে কমে আসবে। এ ছাড়া বিনা টিকিটে ভ্রমণ শূন্যের কোঠায় নামাতে হবে। শতভাগ কোচ নিয়ে ট্রেন পরিচালনা করতে হবে, জনপ্রিয় রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনে মনোযোগী হতে হবে। তাহলে রেলকে আবার লাভজনক করা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, পণ্য পরিবহন করে এক ট্রেনে যে পরিমাণ আয় হয়, দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন চালিয়েও তা হয় না। ১৯৯৯-৯৮ অর্থবছরে দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ১২ শতাংশ রেলের মাধ্যমে পরিবহন হতো। এখন পণ্য পরিবহন হয় মাত্র ৩ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, পণ্য পরিবহন করে এক ট্রেনে যে পরিমাণ আয় হয়, দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন চালিয়েও তা হয় না। ১৯৯৯-৯৮ অর্থবছরে দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ১২ শতাংশ রেলের মাধ্যমে পরিবহন হতো। এখন পণ্য পরিবহন হয় মাত্র ৩ শতাংশ।
কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাত্রীবাহী আন্তনগর ট্রেন যেতে সময় লাগে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টা। কিন্তু একই দূরত্বে পণ্য পরিবহনে লেগে যায় দুদিন। পণ্য পরিবহনের সময় কমানো গেলে এই উৎস থেকে আয় বাড়ানো যেত। কয়েক বছর ধরে আয় বাড়াতে ম্যাংগো, ক্যাটল ও পার্সেল ট্রেন চালু করা হয়েছিল। এ তিন উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। পার্সেল ট্রেনে নামমাত্র পণ্য পরিবহন হচ্ছে। অথচ ভারতে রেলওয়ে বছরে শুধু পণ্য পরিবহনে ৫৫ থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করছে। লাভের বড় অংশ তারা ভর্তুকি দিচ্ছে যাত্রী পরিবহনে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, ক্রয় থেকে শুরু করে পরিচালনা—সব বিভাগের সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি। তবেই লাভের মুখ দেখবে রেল।