
প্রতীকী ছবি
‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এই কূটনৈতিক কৌশলকে কাজে লাগিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে বেশ উচ্চতায় নিতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে ভারত হয়ে উঠেছিল প্রতিবেশী হিসেবে আস্থার নাম।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বাংলাদেশের দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েছে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কোনদিকে যাচ্ছে, বৈরিতা নাকি গভীর বন্ধুত্ব কোন নীতিতে চলবে উভয় দেশ; তা নিয়ে এখন চলছে হিসাব-নিকাশ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে শতাধিক মামলা হয়েছে, গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চায় ভারত থেকে তাকে ফিরিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে। এই ইস্যু ঘিরে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক কোনদিকে যাবে তা ভাবনার বিষয় বটে!
অবশ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত সপ্তাহে ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ভারত আমাদের একমাত্র প্রতিবেশী বলা যায়। কারণ চারদিক থেকেই ভারত আমাদের আছে। কাজেই তার সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক হওয়া উচিত এবং হবে। এ ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই, তাদেরও নেই। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা হবে সবচেয়ে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, বন্ধুত্বের শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।
একই সুরে কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সে দেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশীরা একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। এই সম্পর্ক ও যোগাযোগ আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা আগ্রহী।’ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, তারা শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু তাকে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রধান আসামি করা হয়েছে, আমরা তাকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য আইনগতভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।’ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করলেও হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার সম্ভাবনা কম।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস বলেন, ‘তিনি এখানে ভারতের অতিথি হিসেবে অবস্থান করছেন। আমরা যদি আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুর প্রতি মৌলিক সৌজন্য প্রকাশ না করি, তাহলে ভবিষ্যতে কেন কেউ আমাদের বন্ধু হিসেবে গুরুত্ব সহকারে নেবে?’
শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজনীতি-অর্থনীতির পাশাপাশি কূটনৈতিক নানা চ্যালেঞ্জও সামনে এসেছে। বাংলাদেশে কেবল আওয়ামী লীগকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য বিরোধী দলগুলোকে আমলে না নেওয়ায় ভারতের সমালোচনা করে ড. ইউনূস বলেন, ‘কেবল শেখ হাসিনার নেতৃত্বই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে- নয়াদিল্লিকে এই ন্যারেটিভ বাদ দিতে হবে। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দলসহ (বিএনপি) সবাই ইসলামপন্থি এবং এই দেশ আফগানিস্তানে পরিণত হবে আর শেখ হাসিনার হাতে বাংলাদেশ নিরাপদ- ভারত এই আখ্যানে বিমোহিত। ভারতকে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আরেকটি প্রতিবেশী- এটি ভারতকে মনে রাখতে হবে।’
বাংলাদেশের জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বড় একটা ছাপ পড়েছে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে। যেহেতু ভারত বড় প্রতিবেশী, ফলে চলতি টানাপড়েন বাংলাদেশের দিক থেকেও গুরুত্বের সঙ্গে মনোযোগ পাচ্ছে। আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে এ অবস্থা থেকে এই সম্পর্ককে আবার স্বাভাবিক ও সমমর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া যায়, যা উভয়ের জন্য প্রয়োজন।
শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসেছে। সাময়িক সময়ের সরকার হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য-সহযোগিতা তার দরকার। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা ও সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ এবং দরকারি। বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, তা অবজ্ঞা করার মতো নয়।
হাসিনার পদত্যাগের ফলে ভারতের এখন দুটি বাধ্যতামূলক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রথমত বাংলাদেশে যে সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, সেই সরকারকে নিয়ে আগামী দিনগুলোকে ভারতকে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে। হাসিনার আমলে ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির যে ‘আরামদায়ক’ সম্পর্ক, তা এখন যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে।
দ্বিতীয়ত ভারত-চীন প্রতিযোগিতার একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সাবমেরিন, ফাইটার জেটসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম অর্জনের জন্য বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্ক ক্রমবর্ধমানভাবে উষ্ণতা পাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। নয়াদিল্লির দুর্ভাবনা আরও বেড়েছে, যখন তারা জানতে পেরেছে, ঢাকা সম্প্রতি বেইজিংয়ের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। উপরন্তু বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে স্বাক্ষর করেছে। ভারত বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সাহায্য করতে ইচ্ছুক হলেও চীনের আর্থিক সম্পদের সঙ্গে কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারেনি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সম্ভবত এই প্রতিযোগিতার খোরাক জোগাবে।
তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাপক, বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক। অভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ভাগাভাগি, গভীরতর বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের তিন ডোমেইনে দেশ দুটির সম্পর্ক সময় উত্তীর্ণ। শেখ হাসিনা সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত স্থল ও সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। ২০১১ সালে সীমানা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ-ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করে, যা তিন বিঘা করিডর চুক্তি নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশি নাগরিকদের তিন বিঘা করিডর দিয়ে ২৪ ঘণ্টা যাতায়াতের পক্ষে সম্মত হয়।
২০১৫ সালে ভারতীয় সংসদ, সর্বসম্মতভাবে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমানা চুক্তি অনুমোদন করে, যার ফলে দুই দেশের সীমানা নিয়ে বিবাদ শেষ হয়। ২০১৫ সালে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৫০ হাজার বিচ্ছিন্ন নাগরিক, যাদের কোনো জাতীয়তা ছিল না, তারা ভারত অথবা বাংলাদেশের নাগরিক হন। বাংলাদেশ পায় ১৭ হাজার ২৫৮ একর এবং ভারত পায় ৭ হাজার ১১০ একর ভূমি।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে এবং এটি ২০১৫ সালে নবায়ন হয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশের সুবিধার কারণে (সাফটা নেগেটিভ লিস্ট-এর ২৫ ধরনের আইটেম ব্যতীত) ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে গতিশীলতা এসেছে। বাংলাদেশ-ভারত পরস্পরের ভৌগোলিক সীমারেখা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। দুই দেশই পরস্পরের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে বেশ সক্রিয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিবেচনায় ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে তা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান করা সম্ভব।
সন্ত্রাসবাদ নিরসনে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে সীমান্তে নিরস্ত্র লোকজনের হত্যা পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের আরও কাজ করতে হবে। সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মানব, মাদক ও সব ধরনের চোরাচালান বন্ধ করতে চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে উপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ চেহারা কেমন হতে পারে, তা দেখার আগে বুঝে নেওয়া দরকার ভারত ও বাংলাদেশ কেন একে অপরের জন্য অপরিহার্য। নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারত অনেকগুলো ইতিবাচক সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে একে অপরের সম্পূরক হতে পারে, হতে পারে পারস্পরিকভাবে অর্থবহ। পারস্পরিক বিশ্বাস সৃষ্টি এবং সম্পর্কোন্নয়নে একটি রোডম্যাপের কথা ভাবা যেতে পারে। সময়ের ব্যাপ্তিতে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ এই কাজে সহায়ক হতে পারে।
সহজ কথায় বলা যায়, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক নতুন সম্পর্কের ভিত গড়ে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে অতীত ও বর্তমান যেমন উপস্থিত থাকবে, তার চেয়ে বড় আহ্বান নিয়ে দাঁড়াবে ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতের মানুষ। দুই দেশের সরকার পারস্পরিক সমতা, ন্যায্যতা আর সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখিয়ে যে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব।