Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ধোলাইখালে গাড়ির হাড়গোড়

Icon

মীর ইফতেখার উদ্দিন ফাহাদ

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:৪৪

ধোলাইখালে গাড়ির হাড়গোড়

গাড়ির পুরনো ইঞ্জিন। ছবি: সংগৃহীত

ফুটপাতের ওপর ফেলে রাখা হয়েছে গাড়ির পুরনো ইঞ্জিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ইঞ্জিনের নাটবল্টু খুলে সব যন্ত্রাংশ আলাদা করে ফেললেন শ্রমিকেরা। 

ইঞ্জিন থেকে পাওয়া যন্ত্রাংশ মহাজনের হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে আশপাশের বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি দোকানে। বলা হয়ে থাকে এখানের কারিগররা এতটাই দক্ষ যে একটা ইঞ্জিন বা যন্ত্রাংশ দেখে হুবহু আরেকটা বানিয়ে ফেলতে পারেন তারা। পুরান গাড়িকে নতুন আদল দেওয়া, গাড়ির ভেতর ও বাইরের সাজসজ্জা, অচল গাড়ি সচল করা, মেরামতসহ যে কোনো কাজ দক্ষতার সঙ্গেই করে থাকেন এ মার্কেটের কারিগররা। অথচ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কাজ করার মাধ্যমে যতটুকু দক্ষতা অর্জন করেছেন তা দিয়ে চলছে এ কাজ। 

ধোলাইখালের পুরনো যন্ত্রপাতির ব্যবসা ঘিরে পাশেই বেশ কিছু ছোটখাটো কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানে গাড়ির নাটবল্টুর পাশাপাশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী লোহার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বানানো হয়। গাড়ির যে কোনো নাটবল্টু ধোলাইখালে পাওয়া যায়। কোনো কারণে না পাওয়া গেলে আশপাশের কারখানা ও লেদ মেশিনগুলোই ভরসা। কেবল একটি নমুনা (স্যাম্পল) দিলেই চলে।

বলা হয়ে থাকে যে কোনো মোটরগাড়ির এমন কোনো যন্ত্রাংশ নেই, যা পুরান ঢাকার ধোলাইখালে পাওয়া যায় না। রিকন্ডিশন ইঞ্জিন ও মোটর পার্টসের পাইকারি ও খুচরা বিক্রির সর্ববৃহৎ স্থান ধোলাইখাল। পুরান ঢাকার নবাবপুর মোড় থেকে শুরু করে ধোলাইখাল হয়ে নারিন্দা পর্যন্ত পুরো ফুটপাতে পুরনো ইলেকট্রনিকস ও গাড়ির রিকন্ডিশন যন্ত্রপাতি বিক্রি হচ্ছে। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই এখানে পুরনো যন্ত্রাংশের ব্যবসা শুরু হয়। যে কোনো গাড়ির ইঞ্জিন, হেডলাইট, ব্যাকলাইট, হ্যান্ডেল, স্ক্রু থেকে শুরু করে সব ধরনের নাট-বল্টু, লুকিং গ্লাস, ফগ লাইট, মাস্টার সুইচ, গাড়ির গ্রিল, ক্লাচ, গিয়ারবক্স, প্রপেলার শ্যাফ্ট, অ্যাক্সেল, ব্রেক, ব্যাটারি, স্টিয়ারিং ইত্যাদি বিক্রি হয়। মোটরগাড়ির যে কোনো সমস্যার সমাধানও সম্ভব যন্ত্রাংশের এ মার্কেটে। 

১৯৬০ সালে মার্কেটটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় শুধু বাস ও ট্রাকের যন্ত্রাংশই পাওয়া যেত। ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধির সঙ্গে বিভিন্ন যন্ত্রাংশের প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে প্রসারিত হতে থাকে ধোলাইখালের যন্ত্রাংশের ব্যবসা। ছোট এবং বড় মিলিয়ে ৪-৫ হাজার দোকান রয়েছে ধোলাইখালের মার্কেটে। এখানে মালিক-শ্রমিকসহ ৩০-৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান। কিছু দোকান শুধু বিয়ারিং সংগ্রহ এবং বিক্রি করছে। কিছু দোকান শুধু টায়ার অথবা স্টিয়ারিংই বিক্রি করছে। এভাবেই অনেক ব্যবসায়ী নির্দিষ্ট ধরনের যন্ত্রাংশ বিক্রি করছে।

মূলত ব্যবহার অযোগ্য যানবাহন থেকে এ মার্কেটে পুরান যন্ত্রাংশগুলো সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিলামের মাধ্যমে ক্রয় করা হয়। গাড়ির যন্ত্রাংশ পাওয়ার আরও একটি উপায় দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাতিল হওয়া গাড়ি। এসব গাড়ির ভালো যন্ত্রাংশ পুনরায় ব্যবহার করা হয় এবং বাকি অংশটুকু স্ক্র্যাপ আকারে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

ধোলাইখালে উৎপাদিত পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনিক্যাল সেন্টার এবং নিউ মিলবার্ট ইন্টারন্যাশনালের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সড়ক থেকে আড়াই-তিন ফুট ওপরে আনুমানিক চার ফুট বাই ছয় ফুট আকারের ছোট টং দোকান। রুবেল মটরস। ছোট্ট দোকানজুড়ে গাড়ির বিভিন্ন ধরনের নাটবল্টু। ডালায় সেগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেয়ালে ও ছাদের প্রায় সবখানে মালার মতো গাঁথা নাটবল্টু। এক পাশে বসে আছেন দোকানের মহাজন রুবেল হোসেন। ধোলাইখালের সঙ্গে রুবেল হোসেনের সম্পর্ক প্রায় ৪০ বছরের। সেই ছোট বয়সে দোকানে কাজ শুরু করেন। পরে নিজের পুঁজিতে দোকান দিয়েছেন। তার সঙ্গে কথা বলি। জানান, গাড়ির সব ধরনের নাটবল্টুই আছে আমার কাছে। সবই রিকন্ডিশন্ড, মানে পুরান গাড়ির। তবে চাহিদা থাকায় নতুন নাটবল্টু অল্প পরিমাণে রাখি।

সাইদুর রহমান নামের এক পার্টস দোকানদার বলেন, দৈনিক হাজার থেকে ১৫০০ এর বেশি আয় করে। এখানে কলেজ ছাত্ররাও কাজ করে। এই কাজ করতে গিয়ে শরীরে, চেহারায় কালি লেগে থাকে; এ জন্য অনেকে এই কাজকে ছোট মনে করে, অন্য চোখে দেখে। অথচ একজন দিনমজুরও মাসে এই কাজ করে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা অনায়াসে ইনকাম করতে পারে। অনেক ভালো চাকরিতেও এত বেতন নেই।

বলা হয়ে থাকে চুরি বা ছিনতাই যাওয়া গাড়ির যন্ত্রাংশেরও শেষ ঠিকানা ধোলাইখাল। অভিযোগটি বেশ পুরনো। বিষয়টি নিয়ে কৌতুক পর্যন্ত আছে। তবে ধোলাইখালে এখন আর চুরি করা গাড়ি আসে না বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী মোটামুটি গ্যারান্টি দিলেন। তাদের বক্তব্য, মাদকসেবীরা অনেক সময় গাড়ির লুকিং গ্লাস বা হেডলাইট খুলে নিয়ে ধোলাইখালে বিক্রি করতে চলে আসে। তবে সেগুলো ভাসমান ব্যবসায়ীরা কেনে। ভালো ব্যবসায়ীরা কেউ কেনে না। তারা বলেন, চোরাই গাড়ি ধোলাইখালে বর্তমানে আসে না। সেসব বিভিন্ন ওয়ার্কশপে চলে যায়। তা ছাড়া এখানকার ব্যবসায়ীদের কঠোরভাবে বলে দেওয়া আছে, কারও কাছে চুরি করা গাড়ি পেলে তার দোকান আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫