Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ইলিশের রাজনীতি

Icon

সুজিত সজীব

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:১৮

ইলিশের রাজনীতি

ইলিশ মাছ। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

নব্বই দশকের একটি জনপ্রিয় টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার হতো- ‘বাত্তির রাজা ফিলিপস, মাছের রাজা ইলিশ।’ সময়ের পরিক্রমায় বাত্তির রাজা হারিয়ে গেলেও, ইলিশ কিন্তু আরও বেশি শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করেছে। দেশের মানুষের রসনার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে যুক্ত করেছে ভৈাগলিক রাজনীতির অন্যতম অংশীজন হিসেবে। সম্প্রতি আবার নতুন করে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইলিশ নিয়ে চলছে ঠান্ডা যুদ্ধ। 

১৯৪৭ সালের আগে এই প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল, তখন বাংলাও ভাগ হয়নি। তাই একই ভোগৌলিক সীমানার ভেতর থাকায় ইলিশ নিয়ে তেমন কোনো ঝামেলার খবর মেলে না। যা পাওয়া যায় তা হলো- শত শত বছরের রসনা-বিলাসের চিত্র, যা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে তা ভাঙতে শুরু করে দেশ ভাগের পর। ব্রিটিশ-বাংলার মাটিকে কাঁটাতার দিয়ে ভাগ করলেও বাঙালির সংস্কৃতিকে ভাগ করতে পারেনি। দুই দেশের অংশ হয়েও তারা দুপারেই সমানতালে ইলিশ নিয়ে আহ্লাদিপনা চালিয়ে গেছেন। 

তার পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর তা ভিন্নমাত্রা পায়। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে ইলিশ যেতে থাকে কলকাতার বাঙালির পাতে। তা নিয়েও সমস্যার কিছু ছিল না। তবে সমস্যা বাধে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপড়েনে। বাংলাদেশের অনেকের অভিযোগ- ভারত অনেক কিছু চাপিয়ে দিয়ে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। অনেকে অবশ্য ভিন্নমতও পোষণ করেন। তবে সেসব ভিন্ন আলাপ। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- এই বিভেদ। গত পঞ্চাশ বছরে এই বিভেদে ঢুকে পড়ে ইলিশ। 

ইলিশ নিয়ে রাজনীতিতে ও কূটনীতিতে রয়েছে হরেক রকম মতভেদ। তেমনি ইলিশের রয়েছে নানান প্রকারভেদ। চন্দনা ইলিশ, খইরা ইলিশ, জাইতকা ইলিশ, ফাঁসা ইলিশ। নদীর ইলিশ, সমুদ্রের ইলিশ। নদীর মধ্যে আবার মেঘনার ইলিশ, রূপসার ইলিশ, ইলিশা নদীর ইলিশ, পদ্মার ইলিশ, গঙ্গার ইলিশ। এই পদ্মার ইলিশ নিয়েই যত রাজনীতি আর কূটনীতি। পদ্মার ইলিশে তেল বেশি, উজ্জ্বলতা বেশি, স্বাদও বেশি। মূলত পদ্মার ইলিশের চাহিদা বেশি ভারতে; রপ্তানি হয় এটিই। ইলিশ ব্যবসায়ীরা সারাবছর ধরে পদ্মার ইলিশ প্রক্রিয়াজাত করে রাখে। রপ্তানির অনুমতি মিললেই সেটি ভারতে পাঠায়। এ ছাড়া সারাবছর এটি কালোবাজারিদের হাত দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত যায়। 

এ ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে উপহারের তালিকায় ইলিশ ছিল অন্যতম। হাসিনা সরকারের আমলে উৎসবের মৌসুমগুলোতে ভারতে বিপুল পরিমাণ মাছের চালান পাঠানো হয়েছে। সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও ইলিশ উপহার পাঠিয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালে ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জিকেও ৩০ কেজি ইলিশ উপহার দেন শেখ হাসিনা।

২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত ইলিশ, যদিও ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রপ্তানি বন্ধ ছিল। পরে ২০১৯ থেকে নানা কারণে ভারতে আবার ইলিশ রপ্তানি চালু হয়। এটাকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভারতের কাছে নতি স্বীকারমূলক কূটনীতি হিসেবে আখ্যা দেন। তাদের দাবি- বর্তমানে উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশের মানুষের পাতে উঠছে না ইলিশ, সেক্ষেত্রে কোন কারণে কী স্বার্থে ইলিশ রপ্তানি। তবে সেসব কানে তোলেননি শেখ হাসিনা। তিনি তার মতো করেই ইলিশ নিয়ে বা দিয়ে কূটনীতি চালিয়ে গেছেন।  

ফলে পদ্মার ইলিশ দেশের বাজারে সহজে পাওয়া যায় না। পেলেও দাম বেশি। এদিকে দেশে মোট ইলিশ উৎপাদনের কত ভাগ পদ্মার ইলিশ, তার তেমন কোনো তথ্য নেই। তথ্য থাকলে সেখান থেকে কিছু ইলিশ রপ্তানি করা যায়। 

এবারে আসি বর্তমানের পরিস্থিতিতে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও ভারতে গিয়ে অবস্থান নেওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। শেখ হাসিনার আমলে নানা অভিযোগের মধ্যে একটি জনপ্রিয় অভিযোগ ছিল- ভারত প্রীতি। তার সরকারের সঙ্গে ভারতের নানা চুক্তি আর অসমতাভিত্তিক বাণিজ্যিক লেনদেন মানুষের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কথা ওঠে- ভারতে আর কোনোভাবেই ইলিশ রপ্তানি করা যাবে না। 

তবে প্রায় প্রতিবছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে পাঁচ হাজার টন ইলিশের চাহিদার কথা জানিয়ে থাকেন কলকাতার ব্যবসায়ীরা। তবে সেই মোতাবেক সেখানে ইলিশ পাঠানো হয় কিনা, তা নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও একটা কথা নিশ্চিত- প্রতি পূজায় ইলিশ যায় কাঁটাতার পেরিয়ে। 

এবারও গেল, তবে একটু জল ঘোলা করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথম জানায়- দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে ভারতে ইলিশ যাবে না। পরে অবশ্য নানা কারণে পরিস্থিতি বদল হয়। সিদ্ধান্ত হয়, আসন্ন দুর্গাপূজায় ভারতে ইলিশ যাবে। এক্ষেত্রে দৃশ্যের অন্তরালে একটি রাজনৈতিক দাবার ঘুটির চালের আভাস মিললেও তাকে আমলে না নেওয়াই উত্তম; কারণ দুদেশের জনগণ। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যতই বিভেদ থাক, কূটনীতি থাক, মানুষে-মানুষে নেই কোনো বিভাজন। ওপারে উৎসবে আমাদের এপারের ইলিশ আর এপারের উৎসবে ওপারের পণ্য- এই লেনদেন রাষ্ট্র ছাপিয়ে মানুষে-মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধকেই জাগ্রত করে।

তবে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত দুই দেশের দুটি গোষ্ঠীর মানুষ থেকে। এক. ভারতে ইলিশ রপ্তানির খবরে যারা বাংলাদেশের বাজারে ইলিশের দাম বাড়াচ্ছে আর যারা রপ্তানি বন্ধ বলে ওপারে চোরাচালানের মাধ্যমে ইলিশ পাচার করতে সহযোগিতা করছে। এদের প্রতিহত করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ইলিশের সমচাহিদা পূরণ যেমন সরকারের দায়িত্ব, ঠিক তেমনি কাঁটাতারের ওপারেও ইলিশ যাবে কিনা সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কূটনীতির প্রয়োজন, যাতে প্রতিবেশী-বান্ধব আচরণেই আমরা এই অঞ্চলে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিতে পারি। মজার ব্যাপার হলো তা-ও চাইছি কিন্তু ইলিশের মাধ্যমে। আসলেই মাছের রাজা ইলিশ, কূটনীতির পাশাও ইলিশ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫