
মাছ চাষ। ছবি: সংগৃহীত
ময়মনসিংহ জেলার মাছ চাষি রহমত আলী। পৌনে দুই একর জমিতে মাছ চাষ করেন। কৈ, তেলাপিয়া, গ্রাসকাপ, টেংরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করে থাকেন।
সম্প্রতি তিনি লক্ষ করতে পারেন পুকুরের মাছের গায়ে ক্ষত বা ঘাজনিত লাল দাগ দেখা দিয়েছে। এই দাগের আকৃতি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঘা মাছের লেজের গোড়ায়, পিঠ ও মুখের দিকেই বেশি হয়ে থাকে। এটি দেখে তিনি ঘাবড়ে যান। বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। এরপর তিনি তার পাশের গ্রামের জাফর আলীকে বিষয়টি জানান। জাফর আলী তাকে পরামর্শ দেন তার একটি মাছ নমুনা হিসেবে ময়মনসিংহ বিভাগের মৎস্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ফজর আলীর কথা মতো রহমত আলী নমুনা নিয়ে মৎস্য হাসপাতালে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন তার মাছগুলোর পাখনা ও লেজ পচা রোগ হয়েছে। পরে তিনি মৎস্য ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তার পুকুরের মাছগুলোর চিকিৎসা করেন এবং এর থেকে পরিত্রাণ পান।
এ দেশে রয়েছে ১৩ লাখ পুকুর-দীঘি, যার আয়তন প্রায় ৩ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর। আরও আছে ১০ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর আয়তনের ২৪ হাজার কিলোমিটার নদ-নদী, ১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর আয়তনের প্রায় ১১ হাজার বিল, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর আয়তনের বাঁওড়, ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টরের কাপ্তাই লেক, ১ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর আয়তনের সুন্দরবন এবং ২৬ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর প্লাবন ভূমি। তবে দিন দিন কমে আসছে নদ-নদী, খাল-বিলসহ প্রাকৃতিক জলাভূমির আয়তন। তা সত্ত্বেও পরিচিত মাছের সংখ্যা কিন্তু বাজারে কম নয়, বরং বেশ চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের মাটি, পানি ও জলবায়ু মাছ চাষের জন্য খুব উপযোগী। দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এখন মাছ চাষ এবং এ সম্পর্কিত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) মৎস্য সম্পদের অবদান এখন চার শতাংশ। অবশ্য বর্তমানে ৫৬ শতাংশ মাছ আসছে পুকুর থেকে। আর পুকুরে মাছ চাষের কারণে গত তিন দশকে মোট উৎপাদন বেড়েছে ছয়গুণ। সেটি অবশ্য আরও কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব হতো; কিন্তু অধিক লাভের আশায় চাষি তার পুকুরে মাছের ঘনত্ব বাড়িয়ে প্রয়োগ করছে প্রয়োজনের চেয়ে অধিক খাদ্য। এতে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে জলজ পরিবেশ নষ্ট হয়ে রোগজীবাণুর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফলে মাছ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় মহামারি আকারে প্রচুর মাছ মারাও যায়।
এতে একদিকে যেমন উৎপাদন কম হয়, অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন চাষি। আবার রোগ নিরাময়ের জন্য অনেকে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক, রাসায়নিক দ্রব্য বা কখনো নিষিদ্ধ দ্রব্যও (যা পরিবেশবান্ধব নয়) পুকুরে ব্যবহার করে। তখন নিরাপদ প্রাণীজ আমিষের অন্যতম উৎস মাছ মানুষের জন্য আর নিরাপদ থাকে না; জলজ জীববৈচিত্রও ধ্বংস হয়।
এসব সমস্যা থেকে সমাধানের আশায় একদল মৎস্য গবেষক ও বিশেষজ্ঞ নিয়ে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল’। বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. মাসুদ রানা বলেন, এটি একটি স্বেচ্ছাসেবী জনকল্যাণমূলক সংগঠন। দেশের পাঁচটি বিভাগে আমাদের কার্যক্রম চলমান। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে সার্ভিস বুথ ও প্রতিনিধি। পর্যায়ক্রমে আমরা পুরো বাংলাদেশে এই সেবা ছড়িয়ে দিতে চাই।
মৎস্য হাসপাতালের মাধ্যমে প্রতিনিধিরা চাষিদের মাছ চাষের কলাকৌশল, রোগ নিরাময়ের পূর্বপ্রস্তুতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। পুকুর ও জলাশয়ের পানি পরীক্ষা করে আধুনিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও বায়োফ্লক, হাইডেনসিটি, আরএএসসহ যাবতীয় আধুনিক মাছ চাষ সম্পর্কে আগ্রহীদেরও প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হয় হাসপাতালের পক্ষ থেকে। শুধু চিকিৎসাই নয়, মাছের রোগ নির্ণয় ও নিরাময় সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাসপাতালটি গবেষণার কাজও করে।
রফিকুল ইসলাম, একজন সফল মৎস্যচাষি। ময়মনসিংহের কামারগাঁও গ্রামে তার মৎস্য খামার। মোট পাঁচটি পুকুরে মনোকালচার পদ্ধতিতে চাষ করছেন শিং মাছ। ২২ লাখ টাকা খরচ বাদ দিয়ে লাভ করেছেন সাত লাখ টাকা। তবে শুরুর অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর ছিল না রফিকুলের। একেকটি দুঃসংবাদ নিয়ে প্রতিটি ভোর হাজির হতো তার কাছে। অজানা কারণে মাছে মড়ক লাগত। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছিল শত শত শিং। স্বপ্নের খামার বাঁচাতে যার কাছ থেকে যে পরামর্শ আসছিল, তা-ই গ্রহণ করছিলেন; কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। সর্বশেষ অসুস্থ মাছ নিয়ে হাজির হন মৎস্য হাসপাতালে। সামান্য ওষুধ এবং শেখানো কিছু কৌশল দূর করে দেয় তার কপালের ভাঁজ। এর পর আর কোনো ভুল হয়নি, নিজেই এখন মাছের চিকিৎসক। এভাবেই মৎস্য হাসপাতাল মাছ চাষিদের বন্ধু হয়ে উঠেছে।