Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

আবুল কাসেম ফজলুল হক: চিন্তার এক বাতিঘর

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:২১

আবুল কাসেম ফজলুল হক: চিন্তার এক বাতিঘর

আবুল কাসেম ফজলুল হক। ছবি: দীপংকর গৌতম

আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যার। অফ হোয়াইট কালারের জামা-প্যান্ট পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিরাবেগ বোঝাপড়া নিয়ে হেঁটে ডিপার্টমেন্টের সিঁড়িতে পা রাখা অবধি অনেক ছাত্র অনেক বিষয় নিয়ে চলে আসতেন স্যারের কাছে। ছাত্রদের সঙ্গে তার এই সখ্যতার মধ্যদিয়ে স্যারের সঙ্গে পরিচয় নব্বই দশকে।

 পরিচয়ের সূত্র ধরে স্যারের কাছে যাওয়াটা রীতিসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ফটক সোজা বাসায় থাকতেন স্যার। ওই বাসা থেকে স্যারের সম্পাদনায় প্রকাশ হতো ‘লোকায়ত’ নামে সাহিত্য পত্রিকা। স্যারকে এ কাজে সহযোগিতা করতেন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র, আমাদের বন্ধু আরিফ রহমান।

স্যারের বাসা তরুণ প্রগতিশীল রাজনৈতিককর্মী, লিখিয়ে ছাত্রদের জন্য ছিল উন্মুক্ত। সেই সূত্রে যাতায়াত ছিল অবাধ। বাসার কলিং বেল চাপতেই হাসিমুখে দরজা খুলতেন স্যার। জামার বোতাম লাগাতে লাগাতেই শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। সে সময় লক্ষ করেছি সবসময় স্যারের হাতে বই থাকত। কখনো মনে হতো স্যার বই পড়া রেখে উঠে এসেছেন।

বাসায় ঢুকে ডান পাশের রিডিং রুমে বসতেন স্যার। বাসায় গিয়ে বসার পরে অধিকাংশ সময়ই স্যার শুরুতেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘দেশের অবস্থা কেমন? তোমরা দেশ নিয়ে কী ভাবছো? কোনো পরিবর্তন আসবে মনে করো? তরুণদের নিয়ে আমি আশাবাদী-’ স্যারের এই কথাগুলো এখনও কানে বাজে। 

তরুণদের নিয়ে স্যারের আশাবাদ এখনও আগের মতোই। স্যারের কথা বলার ভঙ্গি, বক্তব্যের মায়া-ময়তা, নরম গলার সুরে গাঁথা বাক্যমালায় ভরা মমত্ব যে কাউকে আকর্ষণ করবে। আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যার সবসময়ই চিন্তা ও দার্শনিক মতকে প্রাধান্য দিয়ে কথা বলেন। আজ অবধি তাঁর জায়গা থেকে একটুও সরে আসেননি। তাঁর চিন্তার বড় জায়গা জুড়ে আছে জনগণের আত্মনির্ভরতা, আত্মশক্তি, স্বজাত্যবোধ ও  দেশপ্রেমের বিকশিত রূপ। তিনি এমন একটি জাতি চান, আত্মনির্ভর শক্তিমান, সমৃদ্ধিমান যারা নিজেদেরকে স্বাধীন রাখবে; নিজেদের আত্মবিকাশের পথ নির্মাণ করবে; বাইরের অপশক্তির হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করবে। একই সঙ্গে তিনি আধিপত্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির তীব্র বিরোধী। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের  প্রান্তিক জাতি-গোষ্ঠীগুলো তাদের চিন্তার জগতকে কীভাবে বিস্তৃত ও বিকশিত করবে সেটি তার চিন্তার বড় একটি পর্ব বলা যায়।

আবুল কাসেম ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তার জায়গাটা জুড়ে আছে ‘জনগণ’ সম্পর্কিত ধারণা। আত্মশক্তি বলতে তিনি জনগণের আত্মশক্তি বুঝিয়েছেন তার বিভিন্ন বক্তব্যে ও লেখায়। জনগণের সৃজনশীলতার ওপর আস্থাশীল প্রগতির এই পরিব্রাজক তার অভিজ্ঞতার আলোকে  বিভিন্ন সময় বলেছেন, জনগণ হলো মূল শক্তি। জনগণ জাগলে তাকে থামিয়ে দেওয়ার কোনো শক্তি নেই। পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী হচ্ছে জনগণ।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফজলুল হক ছাত্র রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তারপর থেকে কখনোই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেননি। ফলে তিনি বুঝেছেন, এ  দেশে রাজনীতিকে উন্নত করার আকাঙ্ক্ষিত দলের খুব অভাব। প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনাকারী সংগঠন এ  দেশে অনেক রয়েছে। কিন্তু জনজীবনের সংকট  থেকে মুক্তিপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দল নেই। জনগণকে দীর্ঘমেয়াদী সামগ্রিক কর্মসূচির ভিত্তিতে জনমত তৈরি করে ঐক্যবদ্ধ করতে চায়নি। তিনি বহুবার বলেছেন, এ দেশের বামপন্থিদের গত ১১০ বছরের ইতিহাসে ‘রাষ্ট্রক্ষক্ষমতায় যাওয়ার কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় না। নিতান্ত উল্লেখ করার মতো কিছু পাওয়া  গেলে  যেতেও পারে, কিন্তু একটি জাতিভিত্তিক প্রগতিশীল কর্মসূচি সমাজতান্ত্রিক অভিমুখী কর্মসূচি নিয়ে, জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগোনোর  কোনো  চেষ্টা  কোনো চিন্তা খুঁজে পাওয়া যায় না’ (আবুল কাসেম ফজলুল হক; রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ; কথাপ্রকাশ, পৃষ্ঠা ২৩৭)।

তার অনেক লেখাতেই নেতৃত্ব ও রাজনীতির বিষয়টি ঘুরেফিরে এসেছে। আবুল কাসেম ফজলুল হকের রাষ্ট্রচিন্তা আবর্তিত হয়েছে ইতিহাসের আলোকে। তিনি বিশ্বায়নবাদী চিন্তার আবির্ভাবকে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিকশিত রূপ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার গতি-প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রেখে মানব ইতিহাসের অভিজ্ঞতার আলোকে জণগণের মুক্তি ও আত্মনির্ভরতাকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনি  সমাজতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও জনগণের মুক্তির বিষয়টি নিয়ে তিনি তার চিন্তার বিকাশের পথে হেঁটেছেন।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন, চীনের পুঁজিবাদী অর্থনীতির পথে যাত্রার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু বদলেছে, বদলেছে অনেক মানুষের চিন্তার জগত। ভোল পাল্টেছেন অনেক বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকরা। কিন্তু আবুল কাসেম ফজলুল হক তার চিন্তা থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। বরং হতাশ মানুষকে শুনিয়েছেন আশার বাণী। জনগণের রাষ্ট্র, কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠন বিষয়ে তিনি মত প্রকাশ করেছেন নিজস্ব দার্শনিক চেতনার জায়গা থেকে। কিন্তু এই চিন্তাবিদ সবচেয়ে বেষি মুষড়ে পড়েন ২০১৬ সালের ৩১ নভেম্বর রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ অফিসে তার সন্তান প্রকাশক  ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যার পরে। শাহবাগের আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটে দীপনের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ের  ভেতরে বসেই দুর্বৃত্তরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পরে আবুল কাসেম ফজলুল হক শোকাহত অবস্থায়ই রাষ্ট্রের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বলেন, তিনি এই হত্যার বিচার চান না। তার এই অনাস্থা জানানোর পরে রাষ্ট্রও থমকে গিয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনার বিচার হয়েছে। 

তারপরও ভালো নেই সবার শ্রদ্ধেয় আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যার। সন্তান হারানোর শোক তাকে পলে পলে কুড়ে খায়। এর মধ্যে প্রতিটি দলে রাজনীতিহীনতা। রাজনৈতিক দলগুলোর দলাদলির রাজনীতিতে তিনি আরও আহত হন। রাজনৈতিক বাস্তবতা জনগণের পক্ষে না থাকলে  দেশে ভালো কিছু হতে পারে না। এই সংকটের দায় রাজনীতিবিদদের। তবে বিভিন্ন সংগঠনের আলোচনা সভায় বক্তৃতা দান, পড়াশোনা ও লেখালেখির মধ্য দিয়েই কাটে তার সময়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ১৯৪৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ চার দশক শিক্ষকতা করেছেন। আবুল কাসেম ফজলুল হক একজন নীতিবাদী রাজনৈতিক দার্শনিক। তার সব লেখায় উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির চিন্তা ও আশার প্রকাশ থাকে। তার কর্মমুখী চিন্তাশীলতা অনুশীলনের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, জ্ঞানতত্ত্ব, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে তার যুক্তিগ্রাহ্য বুদ্ধিদীপ্ত গবেষণামূলক রচনা আমাদের চেতনা ও বিবেচনাবোধকে শাণিত ও সমৃদ্ধ করছে। তিনি  দেশের শ্রমিক-কৃষক, গরিব  মেহনতি মধ্যবিত্ত সাধারণ জনগণের একজন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্ব এবং স্বদেশ চিন্তার এক বাতিঘর।  বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও উন্নতির জন্য তিনি লিখেন এবং দেশ ও সমাজের অগ্রগতির বিষয়ে চিন্তাশীল। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মুক্তিসংগ্রাম (১৯৭২), কালের যাত্রার ধ্বনি (১৯৭৩), একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন (১৯৭৬), উনিশশতকের মধ্যশ্রেণি ও বাঙলা সাহিত্য (১৯৭৯); রাজনীতি ও দর্শন (১৯৮৯) ইত্যাদি। 

তিনি তার লেখক জীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৪ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার, ১৯৮১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।

চিন্তার বাতিঘর অধ্যাপক আবুল কাসেমের জন্মদিনে তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫