
যাত্রীবাহী লঞ্চ। ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলো অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক প্রশস্ত ও খরস্রোতা। এসব নদীতে চলতে অনেকেই ভয় পান। দুস্তর ঢেউ জলযানকে যেন ভরা নদীতে ডুবিয়ে দেবে। শঙ্কিত হয়ে নদী পাড়ি দেয় যাত্রীরা। চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদী পাড়ি দিয়ে মেঘনায় ঢুকতে লঞ্চের দোলা লাগে। এই দোলা খেতে খেতে মনপুরা, হাতিয়া, রাঙ্গাবালি, চর কুকরিমুকরি, চরফ্যাশন- এসব জনপদে যেতে হয়। সাগরসংলগ্ন এলাকার নদীগুলো প্রচণ্ড খরস্রোতা। সেই স্রোতে দুলতে দুলতে চলে জীবন। এসব এলাকার লোকের কাছে এটি কোনো ঘটনাই নয়; কিন্তু যারা বেড়াতে যায়, অতবড় ঢেউয়ের তরঙ্গ অতিক্রম করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য। তার পরও নদীমাতৃক বাংলার বিভিন্ন জনপদ ঘুরতে মানুষ পাড়ি দেয় উত্তাল সব নদী। ক্রুজারের মতো বড় বড় লঞ্চেও ভয়ের শেষ থাকে না। তার পরও যেসব নদীর কথা বলা হচ্ছে, নাব্যতা হারিয়ে নদীপথ শংকুচিত হলেও নাগরিক জীবন থেকে নদীপথে চলতে ঢেউ পার হয়ে পৌঁছানো এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগের দিকেও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলো ছিল প্রমত্তা। সেগুলোর ঢেউ দেখলে তখন যে কোনো মানুষ ভয় পেতো। ভরা নদীতে ঢেউ ভেঙে সামনে এগোতে চালকরা ভয় না পেলেও যাত্রীরা প্রমত্তা নদীতে ঢেউয়ের ভেতরে পড়লে মনে করতো আর ফেরা যাবে না। পঞ্চাশের দশকে নদীপথে চলাচলের বাহন ছিল গয়না নৌকা। এসব নৌকা তৈরি হতো মজবুত কাঠ দিয়ে। দৈর্ঘ্যে ৫০ ফুট আর প্রস্থে ১০ ফুটের মতো ছিল গয়না নৌকা। বড় আকারের এসব নৌকায় ৪০-৫০ যাত্রী অনায়াসে যেতে পারত। খুব সকাল বলতে সূর্য ওঠার আগেই গয়নার মাল্লারা হাঁকডাক শুরু করত ‘গয়না আইছে, গয়না আইছে’ বলে। জঙ্গল আর ঝোপঝাড় ছিল পথের দুই ধারে। শেয়াল আর সাপখোপের ভয়ে যাত্রীরা ঘাটে রওনা দিত দলবেঁধে। এখন সেদিন নেই। নদীর প্রমত্তা ঢেউ নেই। নদীতে বিলাসবহুল লঞ্চগুলো জাহাজকে হার মানায়। এখন নদীপথ আর আগের মতো ঝঞ্জা-ক্ষুব্ধ নেই।
এখন লঞ্চে বেড়াতে গেলে পুরনো দিনগুলোতে পথ চলার সময়গুলো বলার জন্য- পথের ইস্টিশনের-লঞ্চমালিকদের মধ্যে কে প্রথম লঞ্চ নদীতে ভাসিয়েছিলেন সেসব গল্প আকারে বলেন একদল শিক্ষিত ইতিহাস সচেতন তরুণ। লঞ্চ স্পটারস নামের এই পেশার তরুণরা নদীপথে চলার আনন্দকে আরও বাঙময় করে তোলে যাত্রীদের ইতিহাস শোনানোর মধ্য দিয়ে।
লঞ্চ স্পটারস তুহিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানালেন, বরিশালের নামকরণের কারণ। একদা বড় বড় শাল গাছ থাকায় বরিশাল নাম হতে পারে, আবার লবণের দানা বা বড়ি থেকেও এ নামের উৎপত্তি হতে পারে। কারণ এখানে যে লবণের দানা পাওয়া যেত, তা ছিল বড় বড়, সেগুলোকে বলা হতো বড়িসল্ট। এই বড়িসল্ট দিনে দিনে বরিশালে রূপান্তর হতে পারে- এটা বিশ্বাস না করার কিছু নেই। বরিশালের পুরনো নাম চন্দ্রদ্বীপ বা আগা বাকের খাঁর রাজধানী বাকেরগঞ্জ; তরুণ লঞ্চ স্পটারদের মুখে এসব শুনতে পেয়ে ভ্রমণ আরও আনন্দময় হয়ে ওঠে। তবে লঞ্চের এ ধরনের আয়োজন বা শিক্ষিত তরুণদের তৈরি এক নতুন পেশার সন্ধান পেয়ে আরও ভালো লাগা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাদের বলা ইতিহাসের এমন অনেক উপাদান আছে, যেগুলো আগে অনেকেরই অজানা ছিল। সেসব জানা ভ্রমণের সঙ্গে নতুন উপাত্ত যোগের আরেক ধাপ।
লঞ্চ স্পটারসদের উদ্ভব বেশিদিন না। ফেসবুকের মাধ্যমে প্রথম এরা একটি গ্রুপ খোল। ২০১২ বা ১৩ সালে এটি প্রথম পেজ হিসেবে চালু হয়। আলিম শিকদার, ফায়জুল হক মানু ছিলেন পেজের অ্যাডমিন। ভোলায় তাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। লঞ্চের ভেঁপুর শব্দে তাদের প্রাণে চঞ্চলতা তৈরি হতো। এক সময় লঞ্চ স্পটারস গ্রুপটি তাদের নজরে আসে। সেই থেকে যাত্রা শুরু হয় লঞ্চ স্পটারস বাংলাদেশের। এখন গ্রুপের অ্যাডমিন ২ জন আর মডারেটর ৪ জন। এদের সবাই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ নন। লঞ্চ ভ্রমণ ভালোবাসেন এই টুকুই। লঞ্চে এখন এসেছে হাইড্রলিক সিস্টেম, যার তুলনা চলে অটো কারের সঙ্গে। আরও যুক্ত হয়েছে ফগ লাইট, জিপিএস। গতি বেড়েছে প্রায় সব লঞ্চের। ঈগল-৩ নামের একটি লঞ্চের কথা বলা যায়, যেটি চলে প্রায় ১৪০০ অশ্বশক্তিতে। লঞ্চগুলোয় ইঞ্জিন থাকে ২টি। সরাসরি চীন থেকেও আসে এগুলো, পুরো আনকোরা আবার চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে জেনারেটর মডিফাই করেও তৈরি হয়; কিন্তু গয়নার নৌকায়, বিষখালী, পায়রা, মেঘনা বা ডাকাতিয়া পার হওয়ার পর লঞ্চের আগমন ঘটে কীভাবে? সেটাও জানা দরকার। ৭৮ বছর আগে যে মানুষটি প্রত্যন্ত জনপদে মালপত্র পৌঁছানোর কথা ভেবেছিলেন, তার নাম আব্দুস সাত্তার খান। তিনিই পরে প্রতিষ্ঠা করেন মেসার্স ফারুক শিপিং নেভিগেশন। সাত্তার সাহেবের বড় ছেলে ফারুক ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। ফারুকের স্মৃতি ধরে রাখতেই মেসার্স ফারুক শিপিং নেভিগেশনের জন্ম। ১৯৬২ সালে প্রথম মিন্টু খান ও ফারুক ইসলাম নামে দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চ নামান সাত্তার খান। দেড়তলা উচ্চতার লঞ্চগুলোর বডি ছিল কাঠের। চলত ঢাকা-ভোলা-ঢাকা রুটে। এর পাঁচ বছর পর ১৯৬৭ সালে ফারুক নেভিগেশন পটুয়াখালী রুটে নামাল দুটি লঞ্চ, যেগুলোর নাম ছিল বিউটি অব বিক্রমপুর ও মাসুদ খান। একই বছর আবার চমকে দিল প্রতিষ্ঠানটি, ভোলা রুটে সিদ্দিক খান নামের একটি স্টিলবডি লঞ্চ নামিয়ে। তবে বরিশাল রুটে ‘ডাইরেক্ট সার্ভিস’-এর প্রথম লঞ্চও চালু করে ফারুক নেভিগেশন, স্টিলবডির শাকিল খান লঞ্চটি দিয়ে। আসলে বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, গলাচিপা, বরগুনা, হুলারহাট, লালমোহন, ঝালকাঠি, কালাইয়া ও পাতারহাটে প্রথম স্টিল বডির লঞ্চ আনে ফারুক শিপিং। বৃদ্ধ থেকে মধ্য বয়সি- অনেকেরই মনে পড়বে এ ইতিহাস।