
শরণার্থীর প্রতীকী ছবি
‘আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী?/জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার/আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো-’ কবি আসাদ চৌধুরী তার ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবনের কথা বলেছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে ভারতের শরণার্থী শিবিরের গল্প শুনেছি আত্মীয়-স্বজনের মুখে। শুনেছি অবর্ণনীয় দুঃখগাথার কথা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ কলকাতায় এসেছিলেন। যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশার কথা ফুটে উঠেছিল তার ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায়। শরণার্থী শিবিরের দুঃখ-কষ্টের শিলালিপি তেল আবিব বা পেন্টাগনে পৌঁছবে না, বুঝবে না পাকিস্তানি জান্তারাও; কিন্তু বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, তুরস্ক, ইরান, জর্ডানের শরণার্থী শিবিরের কথা ভাবতেই ভারতে আশ্রিত আশি লাখ শরণার্থীর চিত্র ফুটে ওঠে, যার এক লাখ মারা গিয়েছিল ডায়রিয়ায়। রোগ-শোক না হয় বাদই দিলাম, নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়ার চেয়ে আর কত কষ্ট হতে পারে একজন মানুষের? তার পরও শরণার্থী বাড়ছেই। আগে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নানা সংকট দেখা দিলে যুদ্ধ বাধতো। এখন আধুনিক সব মারণাস্ত্র বিক্রির জন্য যুদ্ধ বাধানো হয়। এখন সেই জাতি তত আধুনিক, যারা সবচে কম সময়ে বেশি মানুষ হত্যা করতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, যারা হুমকি ও ঝুঁকির কারণে জীবন বাঁচাতে বসতি বা আশ্রয় ছাড়তে বাধ্য হয়, তারাই শরণার্থী। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের কথা- মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা থেকে বাঁচতে নাফ নদ পার হয়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে থেকেই প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। বর্তমানে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নিয়ে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। সেসব শরণার্থী শিবিরে গেলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র বিম্বিত হয়। বাংলাদেশের পরই আসে রুশ-ইউক্রেন প্রসঙ্গ। রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে। এই আক্রমণকে আন্তর্জাতিকভাবে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করে, ৮.৮ মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে এবং আরও লক্ষাধিক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত। রুশ আগ্রাসনের কারণে ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ লাখ লোক শরণার্থী হিসেবে ইউক্রেন ছেড়েছে। তবে সম্প্রতি শরণার্থীর ঢল কিছুটা হ্রাস পেলেও যুদ্ধে নতুন নতুন এলাকা আক্রান্ত হচ্ছে। যুদ্ধের তীব্রতা যত বাড়ছে, বাড়ছে শরণার্থী সংখ্যা। পোল্যান্ড, রোমানিয়া, মালদোভা, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়ায় বিপুল সংখ্যক ইউক্রেনীয় আশ্রয় নিয়েছে। কেবল পোল্যান্ডেই ২৩ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। সিরিয়ায় ১১ বছর ধরে চলা বিধ্বংসী যুদ্ধেও এত দ্রুত, এত অধিক সংখ্যক শরণার্থী-সংকট তৈরি হয়নি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এই হামলা থেকে বাদ যায়নি শরণার্থী শিবিরও। ইসরায়েলের উপর্যুপরি হামলায় প্রায় ৪১ হাজার ৬০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন; কিন্তু এর মধ্যে কত হাজার শরণার্থী রয়েছে তার হিসাব এখনও হয়নি। যুদ্ধবাজদের কারণে শরণার্থীর হিসাব কষলে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলি ইহুদিবাদী শক্তি সাত লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে বাস্তচ্যুত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতের পর জাতিসংঘ ১৯৫১ সালে ইউরোপে শরণার্থী অধিকারসংক্রান্ত সনদ প্রস্তুত করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হয় ফিলিস্তিনে। ১৯৮০ সালে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা প্রথম এক কোটির ঘরে পৌঁছায়। আফগানিস্তান ও ইথিওপিয়ার যুদ্ধ ১৯৯০ সালে এই সংখ্যা দুই কোটিতে নিয়ে যায়। পরবর্তী দুই দশকে শরণার্থীর সংখ্যা মোটামুটি স্থির ছিল; কিন্তু ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযান, ২০০৩ সালে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর ইরাক অভিযান এবং দক্ষিণ সুদান ও সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে। ২০১১ সালে দেড় কোটি শরণার্থী এক দশকে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। শরণার্থী সনদ প্রস্তুত হওয়ার সময় বিশ্বে মাত্র ২১ লাখ শরণার্থী ছিল। ২০২১ সালের শেষে এ সংখ্যা তিন কোটি হয়। এ মুহূর্তে তুরস্ক বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশ। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার মধ্যেও বিভিন্ন দেশে সেবাদানকারী সংস্থার রাজনীতি আছে। কারও মানবিক সাহায্যের বিষয়ও রয়েছে; কিন্তু বর্তমান বিশ্বের আধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রির যে রাজনীতি, তাতে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ দিনের পর দিন যুদ্ধ বাধাচ্ছে। আধুনিক সব মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আয় করছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার। আর সাধারণ মানুষ জীবন বাঁচাতে হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। যুদ্ধ থামলে বড় দেশগুলোর অর্থনীতিতে ভাটা পড়বে। তাই যুদ্ধ থামানোর কোনো উদ্যোগ নেই। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে; বাড়ছে শরণার্থীর সংখ্যাও। এর মধ্যে জাতিসংঘ রয়েছে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’-এর ভূমিকায়।
তা হলে এই অবস্থা কি চলতেই থাকবে? যুদ্ধ থামবে না, শুধু মৃত্যু আর শরণার্থীর পরিসংখ্যান হবে? আমরা বলি মানবিক সাহায্য নয়, পরিসংখ্যান নয়, দরকার এই যুদ্ধবাজ দেশগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।