Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

আশ্বিনের বুড়িগঙ্গা

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৫৩

আশ্বিনের বুড়িগঙ্গা

বুড়িগঙ্গা নদী। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ কেন নদীমাতৃক সেটি বোঝার জন্য দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নানা সংকটের ভেতরেও খোদ রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গায় বছরের এই সময়, আশি^নে অর্থাৎ যখন নদীতে পানির প্রবাহ বেশি থাকে; বৃষ্টি ও বন্যার কারণে পানিতে দুর্গন্ধ থাকে না; পানির রঙ বেশ স্বচ্ছ, তখন অসংখ্য ছোট-বড় নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলার; এমনকি ছোট ছোট লঞ্চও দেখা যায় যাত্রী পারাপার করছে। 

বিআইডব্লিউটিএর সার্ভে জাহাজ ‘বালু’। কমলা রঙের সুন্দর এই ছোট নৌযানটি কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাদের সঙ্গী হয়েছিল। উদ্দেশ্য- বুড়িগঙ্গার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে যেতে আশ্বিনের নদীর চেহারাটা দেখা। রাজধানীর বসিলা এলাকার ওয়াশপুর হচ্ছে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের মিলনস্থল। এখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু। গন্তব্য নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা। 

২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার। ওয়ার্কিং ডেতে রাস্তার যানজট মাড়িয়ে নির্ধারিত সময়ের কিছু পর সবাই হাজির মোহাম্মদপুর লঞ্চঘাটে। সেখানেই নোঙর করেছে ‘বালু’। রাজধানীর পূর্বপ্রান্ত ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদীর নামে তৈরি এই জাহাজে উপস্থিত নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন- এমন জনা তিরিশেক মানুষ। 

বেলা ১১টার দিকে যাত্রা শুরু। জাহাজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পশ্চিম প্রান্তে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দেখিয়ে রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বললেন, এখান থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার নদী গায়েব করে দেওয়া হয়েছে, যা একসময় বুড়িগঙ্গারই অংশ ছিল। খোদ রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রধানতম নদীটির ১৬ কিলোমিটার গিলে ফেলা হয়েছে- এটিও বিশ্বাসযোগ্য? রোকন বললেন, তারা মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে, বসিলা থেকে পশ্চিম দিকে বুড়িগঙ্গার ১৬ কিলোমিটার পুরোপুরি দখল।

জাহাজের যাত্রা শুরু। বছরের এই সময়ে, অর্থাৎ বর্ষা শেষ ও শরৎ এমনকি হেমন্তেরও কিছুটা সময় বুড়িগঙ্গার পানি তুলনামূলক ভালো থাকে, বিশেষ করে বসিলা থেকে দক্ষিণে সদরঘাটের আগ পর্যন্ত পানি বেশ স্বচ্ছ; কোনো দুর্গন্ধ নেই। 

আমাদের জাহাজ যখন দ্রুত বেগে এসব নৌযানকে ওভারটেক করে যাচ্ছিল, তখন নৌকা ও ট্রলার থেকে উৎসুক মানুষেরা হাত নেড়ে অভিবাদন জানান। কেননা জাহাজে লাগানো মাইক থেকে নদী সুরক্ষায় সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে বিভিন্ন মেসেজ দেওয়া হচ্ছিল। 

যারা প্রতিনিয়ত নদীতে যান, নদী যাদের জীবন ও জীবিকার প্রধান উৎস তথা যারা নদীনির্ভর, তারা জানেন নদীর পানি কালো হয়ে গেলে, দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে গেলে তার কী কষ্ট! বিশেষ করে ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী কয়েক মাস বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়ালেও দুর্গন্ধে নাক চাপতে হয়। নানাবিধ উদ্যোগে এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও বুড়িগঙ্গার দুষণ এখনও একটি বিরাট ইস্যু। তবে বছরের এই সময়টায়, অর্থাৎ আষাঢ় থেকে কার্তিক- এই পাঁচ মাস বুড়িগঙ্গার চেহারা বেশ বদলে যায়। 

সদরঘাটের কিছু আগে কামরাঙ্গীরচর এলাকার একটি ঘাটে অসংখ্য নৌকার আনাগোনা আর মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ড দেখে মনে হলো- আহা, এই তো গ্রামবাংলা। এর কিছু পরই ব্যস্ত সদরঘাট। বাবুবাজার সেতুর নিচে বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ। যদিও ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা কমলা রঙের সেই জাহাজগুলো চোখে পড়ল না। 

নদীর পূর্বপ্রান্তে সদরঘাটের পন্টুনে সারিবেঁধে নোঙর করা দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী অসংখ্য লঞ্চ। পাশেই শ্যামবাজার। অন্য প্রান্তে রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক হাব জিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ। দক্ষিণে যেতে যেতে ব্যস্ততা কিছুটা কমে; কিন্তু দুপাশে দৃশ্যমান হতে থাকে অসংখ্য শিল্প-কারখানা। বুড়িগঙ্গার দুই পারের এই শিল্প-কারখানাগুলোর অপরিশোধিত বর্জ্যই যে নদী সর্বনাশের মূল কারণ, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী অবশ্য বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী করেন ওয়াসাকে। কেননা ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষের পয়োবর্জ্য নানা খাল ও ড্রেন হয়ে শেষমেশ এই বুড়িগঙ্গায় এসে পড়ে বলে তিনি মনে করেন। পয়োবর্জ্য যেভাবে পরিশোধন করা দরকার, সেই ব্যবস্থাটি এখনও অনুপস্থিত।

ফতুল্লার কাছাকাছি একটি জায়গায় নদীর মাঝখানেই জাহাজ নোঙর করে। সেখানের পানি আরও বেশি সুন্দর। মনে হয় গোসল করাই যায়। যদিও নদী গবেষকদের মতে, বছরের এই সময়টাতেও বুড়িগঙ্গায় গোসল করা খুব নিরাপদ নয়। কেননা পানি আপাতদৃষ্টিতে ভালো দেখালেও বর্ষা-শরৎ মৌসুমেও বুড়িগঙ্গায় প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। 

ঘণ্টা চারেকের এই যাত্রায় আশ্বিনে বুড়িগঙ্গার যে চেহারা দেখা গেলো, সেটি আমাদের আশাবাদী করে। নদীর ধর্মই হলো- সেখানে পানির প্রবাহ থাকতে হবে। আর কোনোভাবেই অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য ফেলা যাবে না। উন্নয়নের স্বার্থে নদীর তীরে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে- এটিই স্বাভাবিক; কিন্তু বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেললে নদীগুলো বেঁচে যাবে। কিংবা বুড়িগঙ্গার যতটা ক্ষতি করা হয়েছে, অন্তত সেখানে একটা ফুলস্টপ দেওয়া সম্ভব।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫