Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

অপার সম্ভাবনার সুন্দরবন

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩১

অপার সম্ভাবনার সুন্দরবন

সুন্দরবন। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরের রানি সুন্দরবন, ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলায়। ভোরে, দুপুরে, পড়ন্ত বিকেল আর সন্ধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে সজ্জিত হয়; মধ্য ও গভীর রাতে আবার আরেক রূপ। অমাবস্যায় ভয়াল সুন্দর আবার চাঁদনি রাতে আলো-ছায়ার খেলা পর্যটকদের বিমোহিত করে। বনের রহস্যময়তা, বাঘের গর্জন, হরিণের চকিত চাহনি, বানর আর হরিণের বন্ধুত্ব, কুমিরের কান্না, পাখ-পাখালির কলতান, অশান্ত পানির বুকে উত্তাল ঢেউয়ের উন্মাদ নৃত্য অবলোকন করে পর্যটকরা উল্লসিত, বিমোহিত ও আপ্লুত হয়। 

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই ম্যানগ্রোভ বন এখন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত। ২০০ বছর পূর্বে এর প্রকৃত আয়তন ছিল প্রায় ১৬,৭০০ বর্গকিলোমিটার, যা কমে এখন ১০,০০০ বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। এর ৬৬ শতাংশ বা ৬,০১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে; বাকিটা ভারতের সীমানায়। 

সংকটে সুন্দরবন

বাংলাদেশে পর্যটনের যতগুলো স্পট আছে তার মধ্যে সুন্দরবন অন্যতম। তারপরও অবহেলিত এই বিপুল সম্ভাবনার জনপদ। সিডর, আইলা, ফণী, বুলবুল, আম্পানের মতো বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় থেকে বুক চিতিয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করে সুন্দরবন। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অল্প কয়েক ফুট উপরে অবস্থিত এই বনভূমিতে প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় এসে আঘাত হানছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতটাই সর্বব্যাপী যে, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের ওপর সেই চাপ অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও ম্যানগ্রোভ বন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকা। 

তবে সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান সংকট বন উজাড় হওয়া। গাছ কাটা এবং বনজ সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে কাঠ, মধু এবং অন্যান্য বনজ সম্পদ অতি আহরণের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। খাবার পানির সংকটে স্থানীয়দের মধ্যে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। তা ছাড়া সুন্দরবনের নদীগুলোতে বেড়েছে লবণাক্ততা। নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ভাঙন বেশি আকারে দেখা দিয়েছে। শিবসা, কপোতাক্ষ, মিনাজ, হাড়িয়া নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। স্বাদু পানির অভাবে আজ দেশীয় প্রজাতির শোল, কই, টাকি, মাগুর ইত্যাদি বিলীন হয়ে গেছে। জলাবদ্ধতা, খরা, অতিবৃষ্টির কারণে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি গরু, মহিষ, ছাগল খাদ্যের অভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গাছপালায় তেমন কোনো ফল আসছে না এবং রোগগ্রস্ত হয়ে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির ধান হরিভোক, খাজুরছোড়, বালাম আজ বিলীন হয়ে গেছে। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় এলাকার মানুষ।

সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় শিল্পায়নের প্রবণতা বাড়ছে, যা এই বনভূমির জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ ছাড়া নৌ-যান থেকে তেল ও রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণের ফলে পরিবেশ দূষণও বাড়ছে। সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের বড় একটি অংশ তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা এই বনভূমির জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক বিপর্যয় তৈরি করতে পারে। 

সম্পদ ও সম্ভাবনা

বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসভূমি এই সুন্দরবন। বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি ও প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের পর থেকে দেশি, বিদেশি প্রকৃতিপ্রেমীদের পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে সুন্দরবন। এর ফলে সুন্দরবন হতে পারে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প। এতে উপকূল এলাকার লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অবহেলিত জনপদে প্রাণচাঞ্চল্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। তাই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার যে সুযোগ আমাদের হাতের নাগালে রয়েছে সেগুলো কাজে লাগানো জরুরি। যদি এটি সম্ভব হয়, তাহলে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বদলে যাবে আমাদের দেশের অর্থনীতি। বিশ্বের পর্যটকদের আগমনে বৃদ্ধি পাবে বৈদেশিক মুদ্রা, যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

সুন্দরবন প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এখানকার গাছপালা থেকে পাওয়া মধু এবং কাঠ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি হয়। এ ছাড়া মাছ এবং চিংড়ির মতো সামুদ্রিক সম্পদ সুন্দরবনের নদী ও খাল থেকে সংগ্রহ করা হয়, যা দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

সুন্দরবন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোর জন্য একটি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। এই বনভূমি ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় এলাকাগুলোকে রক্ষা করে। ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড়গুলো ঢেউয়ের শক্তি শোষণ করে এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে, যা উপকূলের মানুষদের জন্য একটি প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যানগ্রোভ বন অন্যান্য বনের তুলনায় বেশি পরিমাণে কার্বন শোষণ করে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে সহায়তা করে। সুন্দরবনের এই বৈশিষ্ট্যটি বিশ্বব্যাপী পরিবেশবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

নানা পরিকল্পনা

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য অনেক আগেই পর্যটন নীতিমালা করা হয়েছে। নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে, সুন্দরবন ও কক্সবাজারের জন্য নেওয়া হবে মহাপরিকল্পনা। কিন্তু নীতিমালার আলোকে এখন পর্যন্ত কাজের তেমন কিছু হয়নি। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ৪টি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সুন্দরবনে দেশি বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবনের করমজল, হারবাড়িয়া, চাঁদপাই ও শরণখোলা এলাকায় পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ নামে একটি প্রকল্প তৈরি করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবিত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সুন্দরবনে যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক নিরাপদ ও আরামদায়ক হবে। 

সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে সরকার, স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংস্থাগুলোর একত্রিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সুন্দরবন রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। বনজ সম্পদ ব্যবহার করার সময় সতর্ক হওয়া এবং পরিবেশ রক্ষার মানসিকতা গড়ে তোলা দরকার। সুন্দরবন রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। বন্যপ্রাণী শিকার, বনজ সম্পদ আহরণ এবং চোরাচালানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সুন্দরবনের ক্ষতি কমাতে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫