Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

হুমকির মুখে নিম্ন আয়ের মানুষ

Icon

হারুন-অর-রশিদ

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২০, ২২:৪১

হুমকির মুখে নিম্ন আয়ের মানুষ

ফরিদা বেগম। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে কাজ হারিয়ে দিশেহারা। ক্ষুধার তাড়নায় ছুটছেন ত্রাণের খোঁজে। ত্রাণের জন্য খিলগাঁও থেকে হেঁটে গেছেন বংশাল। মাত্র আধা কেজি চাল নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে আবার হাঁটা শুরু; কিন্তু ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়। দুর্ভিক্ষ না হলেও ক্ষুধার তাড়নায় জ্ঞান হারিয়েছেন ফরিদা। অন্যদিকে, সরকারদলীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অনেকেই এখন ব্যস্ত ত্রাণের চাল-ডাল-তেল চুরি করে আখের গোছাতে। আবার অর্থনীতির নামে পেটে-ভাতে টিকে থাকা শ্রমিকদের কারখানায় ঢোকাতে চান শিল্প মালিকরা। অথচ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সবার আগে জীবন বাঁচাতে হবে। তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব ভেঙে ঝুঁকি তৈরি করা যাবে না। নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য ঋণ প্যাকেজ না করে স্বচ্ছতার সঙ্গে সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। 

বিশ্বে চলতি বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতে থাকে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে ৮ মার্চ। এরপর ২৬ মার্চ থেকে চলছে সাধারণ ছুটি, অঘোষিত লকডাউন। ইতোমধ্যে এক মাস অতিবাহিত হয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে সবধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ। সারাবিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের ৮ শতাংশের ঘরে থাকা প্রবৃদ্ধি ২/৩ শতাংশে নেমে আসার আশঙ্কা বিশ্ব ব্যাংকের। অদৃশ্য করোনাভাইরাসের ক্ষতি বড় আকারে দৃশ্যমান হচ্ছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘নিঃসন্দেহে করোনাভাইরাসের ফলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের অভিঘাত হবে। আমদানি-রফতানিতে ধস নেমেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে। তবে প্রবৃদ্ধি কী হবে, এ মুহূর্তে তা দেখার বিষয় নয়। মানুষের জীবন রক্ষাই বড় বিষয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়। পর্যাপ্ত খাদ্য থাকা সত্ত্বেও অনেকের কেনার সামর্থ্য থাকে না। বিশেষ করে শহরের রিকশাচালক, দিনমজুর- এমন বিপন্নরাই বেশি সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। বরাদ্দ বণ্টনে দুর্নীতি হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।’

করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়ে স্বার্থসিদ্ধির পথ খুঁজছে কেউ কেউ। চিকিৎসা সরঞ্জাদি নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দেশে উন্নত মাস্ক তৈরির কোনো কারখানা না থাকলেও কাগজে-কলমে সেটি তৈরি হচ্ছে দেখিয়ে সরকারের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চিকিৎসক এবং নার্সদের মাঝে তা সরবরাহও করা হয়েছে। করোনাভাইরাস রোগী শনাক্তকরণে পর্যাপ্ত কিট নেই। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষকরা তা তৈরি করেছেন; কিন্তু সেটি নিতে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যায়নি। গেছে আমেরিকার প্রতিষ্ঠান। দেশে উৎপাদিত কিট পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই স্থাস্থ্য অধিদফতর ব্যস্ত বিদেশ থেকে কিট আমদানিতে। আগের মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনার দুর্নীতির ঘটনার ফলে এই আমদানি বাণিজ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশ এখন অঘোষিত লকডাউনে। সব ধরনের উৎপাদন বন্ধ। বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বড়, মাঝারি, ছোট সব ধরনের শিল্প খাত বিপর্যস্ত। কৃষি খাতে উৎপাদন বন্ধ না হলেও ফসল সংগ্রহ ও বাজারজাত নিয়ে বেকায়দায় কৃষক। কুলি, মজুর, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বিপুল পরিমাণ মানুষের আয়ের পথ বন্ধ। এই অচলাবস্থার মধ্যেই শিল্প মালিকরা কারখানা চালুর চেষ্টা করছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা চালু হয়েছে। এখানে মানা সম্ভব নয় শারীরিক দূরত্ব। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। 

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতের উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভায় বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে শিল্প-কারখানা পর্যায়ক্রমে খুলে দিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঝুঁকির মধ্যেও প্রধান শিল্পখাত ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে।’ 

তবে জীবন বাঁচানের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে লকডাউন অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে। কিন্তু এসব ভাববার সময় এখন নয়। সবার আগে জীবন বাঁচাতে হবে। এ জন্য লকডাউন ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি চালু রাখতে হবে।’

কারখানা খোলা হবে এমন সংবাদ শুনেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হেঁটে হাজির হচ্ছেন শ্রমিকরা। আবার মালিকদের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে ফেরত যেতেও বাধ্য হচ্ছেন। তাদের আনা-নেয়া এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এখানেই শেষ নয়। আশুলিয়ার নরসিংহপুরের একটি কারখানার ৭০৯ শ্রমিককে ছাঁটাই করে বাইরে নোটিস টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের বেতন-ভাতাও পরিশোধ করা হয়নি। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, সংক্রমণের ঝুঁকি এবং তাদের জন্য সুরক্ষিত পরিবহন ব্যবস্থা না করেই কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিকপক্ষ।

পোশাক মালিক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘বিদেশি অর্ডার আসছে। ৮৬৫টি কারখানা চালু করার দাবি আছে। ইতিমধ্যে তিন বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। এখন কারখানা খোলা না থাকলে অর্ডার অন্যদেশে চলে যেতে পারে।’

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এখন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে ঋণের মাধ্যমে। প্রণোদনার নামে ঋণ দেয়াটা এ মুহূর্তে সময়োপযোগী নয়। সবার খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের লোকজনকে শর্তহীন প্রণোদনার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে, বরাদ্দ পাঠাচ্ছে; কিন্তু সেটি সঠিকভাবে বিতরণ হচ্ছে কি না, তার তথ্য নেই। এখানে দুর্নীতি ও অপচয় হচ্ছে। প্রণোদনার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়- স্বচ্ছতা, বিতরণের দক্ষতা এবং সামাজিক জবাবদিহি গুরুত্বপূর্ণ।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫