Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ট্রাফিক জ্যাম এবং আমরা

Icon

সাফিন আহমেদ

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৫

ট্রাফিক জ্যাম এবং আমরা

ট্রাফিক জ্যাম। ছবি: সংগৃহীত

‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো’? ...অন্তত ঢাকার রাস্তায় বসে কারো মনেই যে এই গান বাজে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ আধুনিক মানুষ চায় পথের শেষ, দ্রুত গন্তব্য। কিন্তু ঢাকাবাসীর প্রতিদিনের অনিবার্য সঙ্গী ‘ট্রাফিক জ্যাম’, যা তার গন্তব্যকে করে তোলে দীর্ঘতর, ক্লান্তিকর এবং অনিশ্চিত পথ। নানা অনিষ্টকারী প্রভাব রয়েছে এর। ট্রাফিক জ্যামের কারণে প্রতিনিয়ত শূন্য হচ্ছে রাষ্ট্রের পকেট, নষ্ট হচ্ছে মানুষের মূল্যবান কর্মঘণ্টা এবং দীর্ঘক্ষণ যানজটে অপেক্ষা করতে করতে তৈরি হচ্ছে মানসিক অবসাদ। গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার বার্ষিক আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যানজটের পরিস্থিতি যেভাবে দিন দিন খারাপ হচ্ছে তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও ক্রমেই বাড়তে থাকবে।

কর্মঘণ্টার অপচয়

সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনের গতিবেগ ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যা হেঁটে চলার গড় গতির সমান। ফলে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ১২ বছর আগেও গণপরিবহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার।

এআরআইয়ের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ ট্রিপ সম্পন্ন হয়।  প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের গড় গতিসীমা ছিল প্রতি ঘণ্টায় ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার, যা ২০০৯ সালে কমে ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে দাঁড়ায়। যদি যানবাহনের সংখ্যা একই হারে বাড়তে থাকে এবং নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি ঘণ্টায় মাত্র চার কিলোমিটার হয়ে যাবে, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কম।

আর্থিক ক্ষতি

২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট : আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে প্রতি বছর ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। অর্থাৎ গড়ে বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা কমানো যেত। ২০২৪ সালে এসেও এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে।

কমছে জিডিপি

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির প্রায় ৭ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে, ঢাকা শহরের যানজটের কারণে। বিনিয়োগ বোর্ডের ‘ঢাকা শহরের যানজট ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত করা যেত, তাহলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৭৮ ডলার বা প্রায় ছয় হাজার ২৮০ টাকা বৃদ্ধি পেত। ঢাকার যানজটের কারণে প্রতি বছর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ২৫৬ কোটি মার্কিন ডলার, যা বর্তমান জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ। পৃথিবীর আর কোনো দেশেরই এমন বিশাল আর্থিক ক্ষতি যানজটের কারণে হয় না। শুধু যানজট দূর করতে পারলেই বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশে উন্নীত হতে পারত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৩৫ শতাংশই ঢাকা শহর থেকে আসে।

বাড়ছে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি

যানজটে দীর্ঘ সময় কাটানো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ কারণে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে এবং উদ্বেগও বাড়ছে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যিপজেটের এক গবেষণায়, এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার যানজট অন্যতম স্ট্রেসফুল অভিজ্ঞতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

সম্প্রতি গবেষক জিং হুয়াং ৪০ থেকে ৬৯ বছর বয়সী প্রায় আড়াই লাখ মানুষের ওপর একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালনা করেছেন, যেখানে তিনি নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের সূক্ষ্মকণা মানুষের শরীরে শনাক্ত করেছেন। যে কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বেড়ে যাচ্ছে।

সুতরাং, নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতা এড়াতে যানজট কমানো জরুরি। যদি ট্রাফিক সিগন্যালের সময় কমানো যায়, তাহলে যানজটে কাটানো সময়ও অনেকটাই কমে আসবে, যদিও পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।

সম্ভাব্য সমাধান

বাংলাদেশের যানজট সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত, কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। উন্নত গণপরিবহনব্যবস্থা, স্মার্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, অফিস সময়সূচির সমন্বয় এবং নগর পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর যানজট কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫