Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ফসলের ন্যায্য দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক

Icon

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ১০ মে ২০২০, ০৯:২৩

ফসলের ন্যায্য দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক

চলতি বছর খাদ্য অধিদফতরের মাধ্যমে মোট ২০ লাখ ২৫ হাজার টন খাদ্যশস্য অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। 

এর মধ্যে মাত্র ৮ লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা হবে। বাকি খাদ্যশস্য কেনা হবে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। সরাসরি কৃষকদের কাছে ধান কম কেনার ফলে বঞ্চিত হবে প্রকৃত কৃষকরা। 

এছাড়া গত বছর যে দরে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো ধান-চাল কিনেছিল সরকার এবারো সেই দরেই কিনবে। গত বছরের তুলনায় এবার কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে, আবার করোনাকালীন দুর্যোগের কথাও আমলে না নেয়ায় বঞ্চিত হবেন কৃষক।

এদিকে সরকার নির্ধারিত দামে ধান কেনায় উত্তরাঞ্চলের অনেক কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, করোনাকালীন দুর্যোগে ধান কাটার জন্য শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি টাকা দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে। এছাড়া প্রতি বছরই কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরপরও সরকার ধানের দাম বৃদ্ধি করেনি। আবার সরকার ধানের চেয়ে চাল বেশি ক্রয় করবে। এতে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হবে।

চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কম দামে ধান সংগ্রহ করে বেশি দামে চাল বিক্রি করবে সরকারের কাছে। তবে সরকারের নির্ধারিত দাম নিয়ে এবার মিল মালিকরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একাধিক মিল মালিক বলেন, ধান-চালের এ দর যথেষ্ট নয়। ধান-চাল কেনার আগে থাকতেই তারা প্রতি কেজিতে চার টাকা হারে ভর্তুকি বা ইনসেনটিভ চেয়েছেন।

জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ৮ লাখ টন ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল ও ৩৫ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল এবং ২৮ টাকা কেজি দরে ৭৫ হাজার টন গম কিনবে সরকার। 

গত ১৫ এপ্রিল থেকে গম সংগ্রহ শুরু হয়েছে, শেষ হবে ৩০ জুন। ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে ২৬ এপ্রিল থেকে। ৭ মে থেকে শুরু হবে চাল সংগ্রহ। ধান ও চাল সংগ্রহ চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, ‘এ বছর ধান, চাল ও গমের দাম বাড়ানো হয়নি। আগের দামে কেনা হবে। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষককে প্রণোদনা দেয়া হবে। আর মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল কিনতে দাম বাড়ানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে বারবার বলার পরও সরকারের কাছে খারাপ চাল বিক্রি করে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘ধান-চালের দাম কত নির্ধারণ করা হবে, তা নির্ভর করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওপর। তারা উৎপাদন খরচের যে হিসাব দেয়, তার ওপর ভিত্তি করেই ধান-চালের দর নির্ধারণ করা হয়। এবারো তা-ই হয়েছে।’ 

গত বছরের চেয়ে চলতি বছর বোরো আবাদে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে কি না, জানতে চাইলে কৃষি সচিব মোহাম্মদ নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে খরচ কিছুটা বেড়েছে; কিন্তু সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে গত বছরের দরই রাখা হয়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা বলেন, চালকল মালিক গোষ্ঠীর কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ ওঠে প্রতি বছরই। সেজন্য গত বছর কৃষকের কাছ থেকে চালের বদলে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। এবারো ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও ধানের চেয়ে মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল বেশি কিনবে সরকার। এতে চালকল মালিকরা ধান কিনবে কৃষকের কাছ থেকে। গত কয়েক বছর চালকল মালিকদের একচেটিয়া ব্যবসার কারণে ধানের ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষক দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় ধান ফেলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভও করেছিলেন।

এদিকে কয়েকদিন আগে জাতিসংঘ ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানায়, বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড় আকারের দুর্ভিক্ষ হতে পারে ও এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাতে পারে। এর পেছনে কৃষি উৎপাদন হ্রাস ও অনেক দেশ খাদ্যশস্য রফতানি বন্ধ করে দেয়ার আশঙ্কাকে কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দেশের খাদ্য পরিস্থিতি কেবলমাত্র উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত নয়। এর সাথে কৃষকের ন্যায্য মূল্য পাওয়া ও বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতাও আবশ্যক বিষয়। অথচ কৃষি উপকরণ ও শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও সরকার ধান, চাল ও গমের দাম বৃদ্ধি করেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় খাদ্য উৎপাদন ও মজুদে হয়তো সমস্যা নেই; কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাজার ব্যবস্থাপনাটাই বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। পরিস্থিতি মোকাবেলার সাফল্য নির্ভর করবে বাজার ব্যবস্থাপনা ত্রুটিমুক্ত থাকার ওপর। এ ক্ষেত্রে কৃষিপণ্যের মূল্য ও মজুদ নিয়ে কারসাজি, অন্যায়ভাবে বাজারকে প্রভাবিত করা বা কৃত্রিম সংকট তৈরির মতো অব্যবস্থাপনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক হতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে ধান ও চাল সংগ্রহ করতে হবে। কৃষক বঞ্চিত হলে খাদ্য উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এতে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এছাড়া মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করলে তারা কারসাজি করে দাম বৃদ্ধি করতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারকে সচেতন হতে হবে।’

ধান-চালের দাম নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় অর্ধশতাধিক কৃষক। দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার বোরো ধানচাষি সফিকুল ইসলাম জানান, ‘ধান কাটার শ্রমিক নেই। করোনাভাইরাসের ভয়ে কেউ ধান কাটতে আসছে না। ধান রোপণের সময়ও শ্রমিক সংকট ছিল। গত বছরের তুলনায় সেচ, বীজ সবকিছুরই দাম বেশি। তারপরও গত বছরের দরে এবার ধান-চাল বিক্রি করতে হলে আমাদের লোকসান গুনতে হবে।’

বোরো বাংলাদেশের প্রধান ফসল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়; যার মধ্যে বোরো ৫৪ শতাংশ, আমন ৩৮ শতাংশ ও ৮ শতাংশ আউশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর চলতি বছর ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমি থেকে ২ কোটি টন ধান উৎপাদনের আশা করছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫