Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

তারুণ্যের প্রতিবাদের ভাষা

Icon

রবিউল কমল

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৩

তারুণ্যের প্রতিবাদের ভাষা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের তরুণরা এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়েছেন। লিখেছেন নতুন এক ইতিহাস। সারাবিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে সেই অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের ভাষাগুলো ছিল একদমই অন্যরকম। কখনো তারা বলেছেন ‘আওয়াজ উডা’, আবার কখনো বলেছেন ‘কথা ক’। শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি, ছড়িয়ে দিয়েছেন শহর থেকে গ্রামে, দেশ থেকে দেশান্তরে। তারা কথা বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে। তাদের প্রতিবাদী ভাষায় উঠে এসেছে গাজার কথা। তারা কথা বলেছেন ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।

এই তরুণরা লিখেছেন ‘ফ্রম গাজা টু ঢাকা জাস্টিস মাস্ট বি সার্ভড’ বা ‘গাজা থেকে ঢাকায় ইনসাফ দিতে হবে’ কিংবা ‘ফ্রম ঢাকা টু গাজা, লং লিভ দ্য ইন্তিফাদা’ বা ‘ঢাকা থেকে গাজায় ইন্তিফাদা জারি থাক’। বাংলাদেশের তরুণদের ফিলিস্তিনের সঙ্গে এই একাত্মতা ঘোষণার গুরুত্ব নেহাত কম নয়। কারণ সারাবিশ্ব দেখেছে বাংলাদেশি তারুণ্যের জুলাই বিপ্লব। তাদের বীরোচিত এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আমরা পেয়েছি নতুন এক বাংলাদেশ। 

এই অদম্য তারুণ্যের কথা লিখতে গেলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মুগ্ধর মুখ। কানে বেজে ওঠে ‘পানি লাগবে পানি...’। ভেসে ওঠে বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদের মুখ, আর গুলির শব্দ...। আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এই আন্দোলনে না থেকেও অনেক বেশি উপস্থিত আবরার ফাহাদের নাম।

এই তরুণরা জেগে উঠেছিল বলেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি মুক্ত হয়েছে ফ্যাসিস্ট শাসকের কবল থেকে। যার শাসনামলে পুরো জাতিকে কোণঠাসা করে রাখা হয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো কালো আইন বানিয়ে মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় প্রতিবাদের ভাষা। তাই এই তরুণরা প্রতিবাদ জানাতে বেছে নেন রাস্তা, ভবন কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেওয়াল। তারা দেওয়াল ও রাস্তায় লিখেছেন ‘স্বৈরশাসকের পতন চাই’, ‘ফ্যাসিবাদের পতন চাই’, ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’, ‘আমার ভাই মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’।

তারা আঁকেন মুগ্ধ, আবু সাঈদ ও আবরারের ছবি। সেই ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হন লাখো কিশোর-তরুণসহ সব স্তরের মানুষ। তারা ঘর ছেড়ে বাইরে নামেন, তাদের রক্তে রচিত হলো নতুন এক ইতিহাস। 

প্রতিবাদের ভাষা বন্দি করা হলে তরুণরা হাতে নিয়েছিলেন রং ও তুলি। দেওয়ালে, রাস্তায় লিখলেন ‘আমাদের দেশ আমাদেরই গড়ে নিতে হবে, পিণ্ডির গোলামি ছেড়ে দিতে হবে’। রং ও তুলি হয়ে উঠল একটি হাতিয়ার। আর লেখাগুলো হয়ে উঠল বন্দুকের চেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। প্রতিবাদের এই অস্ত্রের নাম গ্রাফিতি। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গ্রাফিতি শিল্পী ব্যাঙ্কসি একবার বলেছিলেন, ‘যখন লড়াই করার মতো কোনো হাতিয়ার না থাকে, তখন গ্রাফিতি হয়ে উঠতে পারে একমাত্র অস্ত্র।’

এই অভ্যুত্থানে গ্রাফিতি শব্দটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। তবে এটি নতুন কোনো শব্দ নয়, এর আছে দীর্ঘ ইতিহাস। জেমস জে কিলরয় নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে গ্রাফিতির প্রচলন হয় বলে জানা যায়। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি শিপইয়ার্ডের পরিদর্শক। তার অনুমোদনে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হতো। বোঝার সুবিধার জন্য কিলরয় প্রতিটি জাহাজে চক দিয়ে একটি দাগ কেটে দিতেন। কিন্তু শ্রমিকরা বেশি মজুরি নেবে বলে সেই দাগ মুছে দিতেন। একটা সময় শ্রমিকদের এই চালাকি তিনি বুঝতে পারেন। তাই স্থায়ী সমাধান খুঁজতে শুরু করেন। এরপর তিনি চক বাদ দিয়ে দাগ কাটার জন্য রং ব্যবহার করতে শুরু করেন। চকের দাগ সহজে মুছে ফেলা সম্ভব হলেও রঙের দাগ সম্ভব নয়।

তারপর শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানিতে পাঠানো হলো অনেক জাহাজ। তখন বিপত্তি বাধাল কিলরয়ের সেই দাগ। এগুলো দেখে জার্মান প্রেসিডেন্ট ভাবলেন, এটা আমেরিকানদের গোপন কোড। এই সুযোগে স্থানীয় শিল্পীরা জার্মানির অলিগলির দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকতে শুরু করেন, যা নিয়ে চারদিকে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে কিলরয়ের খুব সাধারণ একটি দাগ বা চিহ্ন প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে।

আধুনিক গ্রাফিতির প্রচলন হয় ষাটের দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াতে। ডেরিল ম্যাকরে বা কর্নব্রেডকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক গ্রাফিতির জনক। তার হাত ধরেই সত্তরের দশকে ব্যাপকভাবে গ্রাফিতি ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তা দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একসময় বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদের প্রধান ভাষা হয়ে ওঠে গ্রাফিতি। তবে এসব গ্রাফিতি কে বা কারা আঁকত ও লিখত, তা জানা যেত না।

আমাদের দেশে গ্রাফিতির প্রচলন খুব বেশিদিন আগের নয়। বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিন ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা গেল, শুরুতে আমাদের দেশে গ্রাফিতির ব্যবহার ব্যাপক হারে ছিল না। তবে ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন দেওয়ালে গ্রাফিতির সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। অনেকে হয়তো দেখেছেন, ঢাকার বিভিন্ন দেওয়ালে ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’; ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে’ ইত্যাদি লেখা দেখা যেত। এগুলো হলো গ্রাফিতি। যদিও এগুলোর শিল্পী কে তা আমরা জানতে পারিনি।

এই লেখা লেখার সময় জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল, গ্রাফিতি নিয়ে এই প্রজন্মের ভাবনা কী? এই প্রশ্নটাই করেছিলাম মোহাম্মদপুরের রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মারুফ ইসলামকে। মারুফ উত্তর দিয়েছেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে আমরা প্রচুর গ্রাফিতি এঁকেছি। আমি মনে করি, এটি একটি ইতিবাচক কাজ। শেখ হাসিনার পতনের পর আন্দোলনের চিত্র, বিজয়ের চিত্র, ধ্বংসের চিত্র ও চিহ্ন রং-তুলিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রাফিতির মাধ্যমে। এতে মূলত ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর দ্রোহের ভাষা প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা কেমন বাংলাদেশ চাচ্ছি, সেই বার্তা দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে আছে এসব চিত্রকর্মে। সবচেয়ে বড় কথা, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধদের সাহসের স্মৃতি যাতে পরের প্রজন্ম জানতে পারে, সে জন্য এই গ্রাফিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

মারুফ ইসলামের মতো এই উত্তর হয়তো বাংলাদেশের সব তরুণের।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫