Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বিক্ষোভ ও নিষেধাজ্ঞার দোলাচলে অটোরিকশা

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৮

বিক্ষোভ ও নিষেধাজ্ঞার দোলাচলে অটোরিকশা

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। ছবি: সংগৃহীত

২১ নভেম্বর, রাজধানীজুড়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভে স্থবির হয়ে পড়েছিল ঢাকা শহর। বিক্ষোভের কারণ ১৯ নভেম্বর এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে হাইকোর্টের আদেশে অটোরিকশা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আসে। উক্ত নিষেধাজ্ঞা পরিবর্তনের দাবিতে সম্প্রতি ঢাকা মহানগরী এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের এই বিক্ষোভ শুরু হয়। 

অটোরিকশার ওপর নিষেধাজ্ঞা বারবার এসেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এর আগেও একাধিকবার অটোরিকশা বন্ধের উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মুখে অটোরিকশা রয়েই গেছে। অটোরিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানা গেছে, তাতে প্যাডেল রিকশার বদলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতেই তারা বেশি আগ্রহী। কারণ অটোরিকশা চালিয়ে তারা কম সময়ে তুলনামূলক বেশি আয় করতে পারেন। দ্রব্যমূল্য যে হারে বাড়ছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কোনো মতেই সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং বেশি আয় না করে এখন টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া রিকশা আরোহীরাও যাতায়াতে ব্যাটারিচালিত রিকশাই বেশি পছন্দ করে।

গত দুই যুগে গ্রামের সঙ্গে শহরের এবং রাজধানীর যোগাযোগ বেড়েছে। সড়ক বেড়েছে, বেড়েছে পরিবহন। গণপরিবহনের সংকট মেটাতে ২০০৪ সালে চীন থেকে প্রথম সম্পূর্ণ সংযোজন করা অটোরিকশা আমদানি শুরু হয়। এখন এগুলো স্থানীয়ভাবেই  তৈরি হচ্ছে। সাধারণ প্যাডেল রিকশায় আমদানি করা ব্যাটারি লাগিয়ে সেগুলোকে অটোরিকশায় রূপান্তর করা হয়। আবার দেশীয় পদ্ধতিতে তিনের অধিক যাত্রী নিয়ে চলার রিকশা বানিয়ে তার সঙ্গে মেশিনজুড়ে দিয়েও অটোরিকশা তৈরি করা হয়েছে, তাতে বেশি যাত্রী পরিবহনে সুবিধা। সে ক্ষেত্রে যাত্রীদের ভাড়াও কম পড়ে। 

সম্প্রতি কথা হয়েছে নীলা মার্কেট থেকে খিলক্ষেত আসা কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে। তারা অটোরিকশায় ছয়জন জনপ্রতি ৩০ টাকা দিয়ে আসেন। এখানে অন্যকোনো বাহন নেই। প্যাডেলচালিত রিকশায় একা লাগে ১৫০ টাকা, সিএনজি কম পাওয়া যায়। ভরসা অটোরিকশা। এসব কারণে গত কয়েক বছরে অটোরিকশার সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়েছে। শুধু ঢাকাই নয়, দেশের অন্যান্য এলাকায়ও এই বাহনে সয়লাব হয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০ লাখ অটোরিকশা চলাচল করছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্যাডেল রিকশা ভাড়াও ক্রমাগত বাড়ছে। তাই তুলনামূলক কম খরচে যাতায়াত করতে মানুষ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দিকে ঝুঁকছে। 

ঢাকায় একটি নতুন অটোরিকশা তৈরি করতে খরচ পড়ে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। একটু বড় করে বানালে এক থেকে দেড় লাখ টাকাও পড়ে যায়। একটি অটোরিকশায় চারটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি, একটি মোটর, সুইচ, লাইট ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ থাকে। ব্যাটারির খরচ প্রায় ৩০ হাজার টাকা, আয়ুষ্কাল ছয় মাস থেকে এক বছর। প্রতি রিকশায় মালিককে জমা (ভাড়া) দিতে হয় ৩৫০ টাকা। চার্জ করতে লাগে ৫০ টাকা। ৪০০ টাকা খরচে আয় দাঁড়ায় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। অন্যদিকে একটি প্যাডেল রিকশা ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। আয় হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।

মোহাম্মদপুরের অটোরিকশাচালক হোসেন আলীর কাছে শোনা যায় অটোরিকশা ও প্যাডেল রিকশার কাহিনি। তিনি প্যাডেল রিকশার চেয়ে অটোরিকশাই বেশি পছন্দ করেন। কারণ এ রিকশায় পরিশ্রম কম আবার দ্রুত যাওয়া যায়, আয়ও বেশি। তা ছাড়া ইদানীং যাত্রীদের তাড়া থাকে বেশি। তাই যাত্রীর পছন্দও এটাই। অন্যদিকে প্যাডেল রিকশাচালকরা মাসে মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন।  সেখানে অটোরিকশার আয় কখনো দ্বিগুণেরও বেশি হয়। 

প্যাডেল রিকশায় যে কসরত করতে হয় তাতে দ্রুত অসুস্থ হয়ে যেতে হয়। যে কারণে লাখ লাখ রিকশাচালক জীবিকার জন্য অটোরিকশার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, অটোরিকশার ক্ষেত্রে অর্থনীতির মুনাফা সর্বোচ্চ করার তত্ত্ব প্রযোজ্য। অর্থনীতিতে বলা হয়, একজন ব্যবসায়ীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফা সর্বোচ্চ করা। অটোরিকশা থেকে বেশি ভাড়া ও মুনাফা আসায় রিকশাচালকদের মূলত উৎসাহ দিচ্ছেন গ্যারেজ ও রিকশা মালিকরা।

তবে এসব অটোরিকশার বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক সমস্যা হলো নিরাপত্তা। অটোরিকশার কারিগরি ত্রুটি ও সড়কে অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের কারণে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান ও এ ধরনের তিন চাকার বাহনগুলো ঢাকা শহরের সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। কয়েক দিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অটোরিকশা দুর্ঘটনায় আফসানা করিম নামক এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পরে অটোরিকশা বন্ধের দাবি জোরালো হয়েছে। তা ছাড়া এআরআইয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে সারা দেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫৮২টি দুর্ঘটনা গুরুতর। এ ক্ষেত্রে ৪০ লাখ অটোরিকশা বন্ধের চেয়ে সেগুলোকে আধুনিক করলে রিকশাওয়ালাদের অর্থনীতির যেমন ভারসাম্য থাকে, তেমনি গণপরিবহনের  সংকটও নিরসন হয়। সড়ক অবকাঠামোর জন্য যদি দুর্বল পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটবেই।  একই সঙ্গে অটোরিকশা ও সিএনজির মতো ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লেন তৈরি করলে দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। তাই ৪০ লাখ রিকশার ওপর কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষের রুটি-রুজি নির্ভর করে। এটা বন্ধ করার আগে সব বিষয়গুলো ভেবে দেখা দরকার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫