
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হামলা। ফাইল ছবি
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হামলার খবর শুনে মেজর খালেদ মোশাররফ কিছুটা অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! ওদের আমি বলেছিলাম হোটেল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিস্ফোরণ ঘটাতে, যেন শুধু বিস্ফোরণের শব্দ ওদের কানে যায়- অথচ ওরা করল কি দেখো, হোটেলের ভেতরেই গ্রেনেড ব্লাস্ট করল।’ ব্যাস! কে-ফোর্সের বিশেষ ওই গেরিলা দলটির নাম রাতারাতি হয়ে গেল ‘ক্র্যাক প্লাটুন’!
প্রবল নিরাপত্তা বলয়ে ঢেকে রাখা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর পাকিস্তান সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। কারণ সে সময় হোটেলে অবস্থান করছিলেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিনসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদল। পাকিস্তান সরকার তাদের বোঝাতে চেষ্টা করছিল ‘দেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক’। কিন্তু ক্র্যাক প্লাটুনের এ হামলার পর তাদের আশায় পড়ে যায় গুড়েবালি। মেজর খালেদ মোশাররফ এটাই চেয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিরা জানুক ঢাকাতেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।
২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। শহুরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনায় বিশেষভাবে পারদর্শী করে তোলা হয় তাদের। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ওই তরুণ ও কিশোররা প্রত্যেকেই ঢাকা শহরতলির অলিগলি-রাজপথ ভালো করে চিনতেন। ক্র্যাক প্লাটুন গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা, তাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা। যুদ্ধকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়াও লক্ষ্য ছিল মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন হায়দারের। তারা সফলও হয়েছিলেন।
ঢাকায় থেমে থেমে অতর্কিত গেরিলা হামলার মুখোমুখি হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর- রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম যোদ্ধা শাফি ইমাম রুমীর মা জাহানারা ইমামের দিনলিপি ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের তৎপরতার কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। ২৫ আগস্ট ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডে একটি বড় অপারেশন পরিচালনা করে ক্র্যাক প্লাটুন, রুমী এই অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২৫ মার্চ কালরাতের কথা মাথায় রেখে আগস্টের ২৫ তারিখ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গেরিলা হামলার সিদ্ধান্ত নেয় ক্র্যাক প্লাটুন। সেদিনের গেরিলা আক্রমণের ঘটনাটি জাহানারা ইমাম ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে লিখেছেন, “রুমীরা পিরুলিয়া গ্রামে ওদের ক্যাম্প থেকে দরকারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে আজকেই দুপুরে। ঠিক হয় আলম, বদি, কাজী, রুমী, স্বপন ও সেলিম প্রথমে ধানমন্ডিতে অ্যাকশন করবে। হ্যারিস, জিয়া, মুক্তার, আনু ও আরো দুটি ছেলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করবে। ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডে নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে গিয়ে ওরা দেখতে পায়, সাত-আটজন মিলিটারি পুলিশ গল্প করছে, সিগারেট খাচ্ছে। আলম গাড়ি ঘুরিয়ে আনতে এগিয়ে যায়, যাতে গাড়ির বাঁ দিকে বসা কাজী ও বদি সামনে- পেছনের দুই জানালা দিয়ে ফায়ার করতে পারে। আলম নির্দেশ দিলে কাজী, বদি ও সেলিম গুলি করবে- রুমী ও স্বপন নজর রাখবে, ও তরফ থেকে কেউ অস্ত্র তুলে কি না, তুললে তাদের শেষ করার ভার রুমি আর স্বপনের। গাড়ি ধীরগতিতে বাড়িটির সামনে এনে আলম চাপা গলায় কম্যান্ড দিলো ‘ফায়ার’। অমনি গাড়ির দুই জানালা দিয়ে ছুটে গেল স্টেনগানের গুলি। দুটো স্টেন থেকে দুই লেভেলের গুলি গেল- বদির স্টেন থেকে ওদের পেটের লেভেলে, কাজীর স্টেন থেকে ওদের বুকের লেভেলে। সেলিমও কাজীর সামনে দিয়ে বাঁয়ে ঝুঁকে গুলি করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধপাধপ পড়ে গেল সাত-আটটা তাগড়া শরীর। সমস্ত ব্যাপারটা ঘটতে সময় লাগল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। অপারেশন শেষ করে মিরপুর রোড ধরে সরে যাওয়ার সময় একটি চেকপোস্টের সামনে পড়ে যায় ওরা, সেখানে চলন্ত গাড়ি থেকে চেকপোস্টে গুলি চালিয়ে দ্রুত সরে যেতে যেতে ওরা দেখতে পায় একটি মিলিটারি জিপ ওদের পিছু নেয়। রুমী তার স্টেনগানের বাঁট দিয়ে আঘাত করে গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে ফায়ার শুরু করে, রুমীর দু’পাশ থেকে বদি এবং স্বপনও ফায়ার শুরু করে ভাঙা কাচের ফাঁক দিয়ে। ব্রাশ ফায়ারের সঙ্গে সঙ্গেই জিপটি উল্টে যায়।” এ ঘটনার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিনের বাসা থেকে বদি ধরা পড়েন ২৯ আগস্ট। বদির বন্ধু এনএসএফ কর্মী ফরিদ তাকে ধরিয়ে দেয়।
ইস্কাটনের বাসা থেকে ধরা পড়েন আবদুস সামাদ। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তার স্ত্রী ও শিশুকন্যাকেও। টর্চার সেলে সামাদকে বলা হয়, যদি সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করে তাহলে স্ত্রী ও শিশুকন্যাসহ তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, তা না হলে তার সঙ্গে স্ত্রী ও শিশুকন্যাকেও হত্যা করা হবে। আবদুস সামাদ সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করতে বাধ্য হন। এরপর সেদিন রাতেই জুয়েল, আজাদ ও কাজী কামালকে ধরতে আজাদদের মগবাজারের বাড়ি ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এক ক্যাপ্টেন সিপাহিসহ ঘরের ভেতরে তাদের ধরতে গেলে হঠাৎ কাজী কামাল এক কা- করে বসেন- ক্যাপ্টেনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার স্টেনগানটি ছিনিয়ে নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু আজাদ, জুয়েল পালাতে পারেননি, তারা ধরা পড়েন। এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় রুমী, বাবা শরীফ ইমাম, ছোট ভাই সাইফ ইমাম জামি ও বাড়ির অতিথি হাফিজকে। আরো ধরা পড়েন ফার্মগেট থেকে আবুল বাসার, পুরোনো পল্টন থেকে আজিজুস সামাদ, এলিফ্যান্ট রোডের ট্যানামেন্ট হাউস থেকে মাসুদ সাদেক চুল্লু, মালিবাগের বাসা থেকে শামসুল হক, ইস্কাটনের বাসা থেকে সৈয়দ হাফিজুর রহমান, রাজারবাগের ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক আলভী, লিনু বিল্লাহসহ ছয়জন। সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তেজগাঁও নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরি-সংলগ্ন মিলিটারি টর্চার সেলে। সেখানে গেরিলা ও তাদের স্বজনদের ওপর চলানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন।
নাখালপাড়ার সেই টর্চার সেল থেকে আর ফিরে আসতে পারেননি বদি, রুমী, আজাদ, জুয়েল, হাফিজ, আলতাফ মাহমুদ, বকর, বাশার, বাকী ও সেকান্দার হায়াত খান। কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের। এতজন গেরিলা ধরা পড়ে যাওয়ার পরও ক্র্যাক প্লাটুন আবার ঘুরে দাঁড়ায়। বিজয় অর্জিত না হওয়া অব্দি ক্রমাগত ঢাকা ও এর আশপাশে জোরালো আক্রমণ চালিয়ে যায় ক্র্যাক প্লাটুন।