Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

পেশা ছাড়ছে গাছিরা

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৯

পেশা ছাড়ছে গাছিরা

রসের হাঁড়ি নিচ্ছেন এক গাছি। ছবি: সংগৃহীত

হেমন্তের শুরুতেই দেখা মেলে গাছিদের। কোমরে মোটা দড়ি, বাঁশের একটা ঝাঁপির ভেতরে খেজুর গাছের রসের স্তর বের করা দা, ছুরি, বালি সব নিয়ে শুরু হয় তাদের ব্যস্ততা। গাছে উঠে দড়ি দিয়ে নিজেকে সুবিধামতো বেঁধে শুরু হয় খেজুরগাছের মাথা পরিষ্কার করে রস বের করার প্রক্রিয়া। তাদের কাজকর্ম দেখতে পিছু নিত শিশু-কিশোররা। মনে হয় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা যাচ্ছে। 

গাছিরা প্রথমে খেজুরগাছের মাথায় চড়ে আগাছা সাফ করেন। তারপর নিচের কিছু অংশ কাঁচি দিয়ে চেঁছে যত্ন করে তুলতে থাকেন। ক্রমে একটা প্রায় বৃত্তাকার জায়গা বেরিয়ে আসে। এরপর বৃত্তের মাঝখানে বাঁশের মসৃণ একটি কঞ্চি গেঁথে দেন। এই কঞ্চি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রস হাঁড়িতে গিয়ে জমা হয়। ছয় বা সাত বছর বয়স থেকে একটি খেজুরগাছ রস দেওয়া শুরু করে আর ৩০ বছর পর্যন্ত দেয়। গাছের বয়স বেড়ে গেলে রস কমে যায়, তবে রস খুব মিষ্টি হয়। পরিমাণে বেশি রস পাওয়া যায় মধ্যবয়স্ক গাছ থেকে। পুরুষ গাছ বেশি রস দেয় স্ত্রী গাছের চেয়ে। 

শীতের সঙ্গে রসের সম্পর্ক নিবিড়। শীত যত বেশি পড়ে, রসও তত বেশি হয় এবং স্বাদও বাড়ে। খেজুরের রস মিষ্টি হওয়ার কারণ ফ্রুকটোজ। ঘনত্ব ও তাপমাত্রা দিয়ে ফ্রুকটোজ প্রভাবিত হয়। ফ্রুকটোজের ঘনত্ব যত বেশি হবে, রস ততই মিষ্টি হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ফ্রুকটোজ দ্রবণের মিষ্টতা ১৪৭, যেখানে ১৮ ডিগ্রিতে ১২৮। শীতের মৌসুমের এক মাসে একটি খেজুরগাছ থেকে ৪০-৫০ কেজি রস পাওয়া  যেত। আট লিটার রস জ্বালিয়ে এক কেজি গুড় মেলে।  ২০ থেকে ২৫টি গাছ কেটে রস থেকে যে গুড় হতো তাতে নিয়মিত শ্রম দেওয়ার চেয়ে অনেক বেশি লাভ হয়। 

ঢাকার অটোচালক গনি মিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হলে তিনি জানান, তার বাবা শীতকালে গাছির কাজ করতেন। তিনিও করেছেন অনেক দিন। এখন বয়স প্রায় ৬০। গাছে উঠতে কষ্ট হয়, তা ছাড়া এলাকায় খেজুরগাছ কমে গেছে ইটের ভাটার কারণে। এখন এই ব্যবসা যারা করেন, তারা রসে জল মেশায়, গুড়ে চিনি মেশায়। বেশি লাভ করতে চাওয়ার কারণে এ ব্যবসা ছেড়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। গনি মিয়া যখন গাছ কাটতেন, ১০টি গাছ থেকে যা রস মিলত তাতে একজন গাছি খাওয়া-থাকা বাদ দিয়ে মৌসুমে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারতেন। 

গুড়ের জন্য প্রধান এলাকা ছিল ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চল।  কিন্তু দুই-তিন দশকের ব্যবধানে দেখা গেছে, এসব এলাকার অনেক বাড়িতে একটিও খেজুরগাছ নেই। গাছির সংকট এর প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ, রস থেকে গুড় উৎপাদন করতে প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন। তাই তারা খেজুরগাছ কেটে অন্য গাছ লাগিয়েছেন। ইটের ভাটাও এখানে একটি বড় ভূমিকা রাখে। ফরিদপুরের গঙ্গাবর্দী এলাকার কৃষি ইনস্টিটিউট এলাকার বাসিন্দা এনামুল হাসান গিয়াস খেজুর গুড়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি বললেন, ‘আগের চেয়ে খেজুরগাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তা ছাড়া গাছিও পাওয়া যায় না। তারা এখন  খেজুরের রস ব্যবসা মন্দার কারণে ইজি বাইক চালানোসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন।’

ফরিদপুর ও মাদারীপুরে একসময় খেজুরের গুড় তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। কোনো রকম রাসায়নিক ছাড়াই খেজুরের গুড় উৎপাদন করতেন এখানকার গাছিরা। তাই সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। এখন পরিবর্তিত সময়ে বেশির ভাগ গুড় ব্যবসায়ী রাসায়নিক মিশিয়ে গুড় উৎপাদন করছেন। তাই ৫০০ টাকায় বিক্রি করা যাচ্ছে ঝোলা গুড় আর ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় পাটালি গুড়। এখন খেজুরের রসের ঘাটতিতে বিশেষ চিন্তিত গুড় ব্যবসায়ীরা। শীতকালে খেজুরের গুড় ছিল লোভনীয় খাবার। তখনকার গ্রামবাংলা নবান্নে নতুন সুগন্ধি চাল আর খেজুরের গুড়ে মাতোয়ারা ছিল। এখন নকল গুড়ে সয়লাব বাজার। আসল গুড় উৎপাদনে গাছ ও গাছির অভাব থাকায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন। গত কয়েক বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত অজস্র ভেজাল গুড়ের কারখানা ধরেছেন। যেসব কারখানায় দেখা গেছে ভারত থেকে এক ধরনের কেমিক্যাল (গাদ) নিয়ে আসতেন তারা। এরপর ওই গাদের সঙ্গে চিনি, স্যাকারিন ও খেজুরের গুড়ের ফ্লেভার ব্যবহার করে গুড় তৈরি করা হয়। তারপর চমৎকার সব বিজ্ঞাপন দিয়ে গুড় বাজারজাত করা হয়। বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন এসব অপকাণ্ডে যুক্ত অসাধু ব্যবসায়ীরা। মৌসুম শুরু হওয়ায় এসব নকল গুড় আসল বলে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করছেন একশ্রেণির প্রতারক। আসল গুড়ের ঘাটতি থাকায় সেখানে নকল ঢুকে যাচ্ছে। এভাবে চললে বদলে যাবে শীতের ঐতিহ্য। সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানে বদল আসবে। তাই ধ্বংস না করে খেজুরগাছ লাগানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। আবার গাছ থাকলেও গাছিরা না থাকলে গুড়ের সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে। শীতের ঐতিহ্য রক্ষা করতে গাছ-গাছি দুটোই সংরক্ষণ করা দরকার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫