‘বাগেরহাটের রফিক বাহিনী’ স্বাধীন মুক্তিযোদ্ধার দল

বখতিয়ার আবিদ
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৩
-676e988f759ba.jpg)
রফিক বাহিনীর রফিকুল ইসলাম খোকন। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ বহুমাত্রিক অংশগ্রহণে ছিল বৈচিত্র্যময়। প্রবাসি বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তিবাহিনী ছাড়াও ন্যাপ (ভাসানী), কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি, পিকিংপন্থী বেশকিছু বামদল ও ব্যক্তিনির্ভর মুক্তিবাহিনী দাপিয়ে বেড়িয়েছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। পদ্মা-মেঘনায় পানি যত গড়িয়েছে, সময় তত এগিয়েছে- ধীরে ধীরে জনযুদ্ধে রূপ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ।
বাগেরহাটের রফিক বাহিনী ছিল তেমনই এক মুক্তিযোদ্ধার দল। যার নেতৃত্বে ছিলেন রফিকুল ইসলাম খোকন, তার নামানুসারে দলটির নাম। ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন শেষে রফিকুল ইসলাম ন্যাপের (ভাসানী) কৃষক সমিতির কাজে মনোনিবেশ করেন একই সঙ্গে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির’ হয়েও কাজ করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মাত্র ১১ জন সদস্য ও বুলেটবিহীন একটি রিভলবার নিয়ে রফিক বাহিনীর রণযাত্রার সূত্রপাত। ১৯৭১-এর ১৯ এপ্রিল চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুর গ্রামের হাই স্কুলে ক্যাম্প করেন। সে গ্রামের আনিসুর রহমান, গোবিন্দ দাস ও আজিজুর রহমান ছিলেন রফিকুল ইসলামের রাজনৈতিক সহকর্মী। এরপর রফিকুল ইসলাম, বাহিরদিয়ার মানস ঘোষ এবং পিরোজপুরের ফজলুর রহমান ফজলুর কাছে অস্ত্র চেয়ে লোক পাঠান। মানস ঘোষের কাছ থেকে অস্ত্র না পেলেও ফজলুর রহমান আটটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও কিছু গোলাবারুদ পাঠান।
২৭ এপ্রিল বাগেরহাট শহরে এক ঝটিকা আক্রমণ করে পাঁচটি রাইফেল ছিনিয়ে নেয় রফিক বাহিনী। স্থানীয় থানা, রাজাকার ক্যাম্প এবং পাকিস্তান আর্মি থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়াÑমুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রফিক বাহিনীর অস্ত্রের জোগান এসেছে এভাবেই।
একাত্তরে বাগেরহাট
মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থে স্বরোচিষ সরকার রফিক বাহিনীর বিষয়ে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রফিকুল ইসলাম ওরফে খোকন বাগেরহাট সংগ্রাম কমিটি নিয়ন্ত্রিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সমান্তরালে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং এপ্রিল মাসের মধ্যেই তিনি বাগেরহাট শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদীর অপর তীর থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার উত্তর দিকে
চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র ঘাঁটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুলের একটি দোতলা ভবনে। তবে চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুর গ্রামে সূচিত হলেও রফিকুল ইসলাম খোকন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করেছেন- এগুলোর মধ্যে হালিশহর, শুঁড়িগাতি, ডিংশিপাড়া, জয়গাছি রঘুনাথপুর, বানিয়াগাতি, সুলতানপুর প্রভৃতি গ্রামের নাম উল্লেখযোগ্য।’
জুলাইয়ের ২৪ তারিখ রূপসা থেকে বাগেরহাটগামী রাজাকার বহনকারী একটি বিশেষ ট্রেন আক্রমণ করেন রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এতে ৫০ জনেরও অধিক রাজাকার হতাহত হয়। রফিক বাহিনীর দখলে আসে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
আগস্টের মাঝামাঝির দিকে পাকিস্তানি আর্মির একের পর এক আক্রমণে বিষ্ণুপুরে রফিক বাহিনীর গেরিলারা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হন। সন্তোষপুরের ক্যাম্প হারাতে হয় তাদের। অস্ত্রের সংকট প্রকট হয়। সে সময় রফিকুল ইসলামকে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা থেকে অস্ত্র সংগ্রহের প্রস্তাব দেন মানস ঘোষ। পথে পাকিস্তান আর্মির হামলার মুখে পড়েন। অস্ত্র সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে ৩০ আগস্ট বিষ্ণুপুর ক্যাম্পে ফিরে আসেন রফিকুল ইসলাম।
৯ সেপ্টেম্বর বাগেরহাট সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের পানিঘাট যুদ্ধে অসম এক লড়াইয়ে অংশ নেয় রফিক বাহিনী। ভৈরব নদীর তীর ধরে রফিক বাহিনী ২০০ গজ দূরত্বের মধ্যে ডিফেন্স লাইন নির্মাণ করে। বাঙ্কার খুঁড়ে নদীর বাঁকের দুই দিকে অবস্থান নেয়। প্রতিটি বাঙ্কারে দুজন করে গেরিলা পজিশন নেন। রফিক বাহিনীর ডিফেন্স লাইন ভাঙতে তীব্র গুলিবর্ষণ করতে করতে লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে পকিস্তানি আর্মি ও রাজাকাররা। রফিক বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে সারেং গুলিবিদ্ধ হন এবং একাধিক জায়গায় ফুটো হয়ে লঞ্চটি নদীতে ঘুরপাক খেতে থাকে। একই সময় সড়কপথে পাকিস্তান আর্মির আরেকটি দল এগিয়ে আসতে চেষ্টা করলে রফিক বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যায়। পানিঘাটের যুদ্ধে পাকিস্তানি আর্মির ১৬ জন এবং অসংখ্য রাজাকার নিহত হয়।
১৩ সেপ্টেম্বর দেপাড়া ব্রিজের কাছে গেরিলারা পাকিস্তান আর্মির মুখোমুখি হন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা বিজয় পাল শহীদ হন। পাকিস্তানি আর্মির তিনজন ও পাঁচজন রাজাকার নিহত হয়।
গোটাপাড়া ইউনিয়নের বাবুরহাট বাজারে ৩০ অক্টোবর পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকাররা সম্মিলিতভাবে রফিক বাহিনীর মুখোমুখি হয়। ওই দিন সকালেই তারা ভৈরব নদী পেরিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বাবুরহাটে রফিক বাহিনীর শক্ত অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। কিন্তু রফিক বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের সম্মিলিত বাহিনীর সামনের অংশটি ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।
পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের অন্য অংশটি বাবুরহাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাজারের কাছাকাছি বাঙ্কারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ইউনিফরম পরে অপেক্ষা করছিলেন। আকবর নামের এক কিশোরের মাথায় কার্তুজের বাক্স তুলে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী এগোতে থাকে। ব্রিজের কাছাকাছি যেতেই কিশোরটি খালে লাফিয়ে পড়ে। পাকিস্তানিরা রফিক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের মধ্যে পড়ে। এক ক্যাপ্টেনসহ চারজন পাকিস্তানি সেনা ও তিন রাজাকার নিহত হয়।
বাবুরহাটে ৯ নভেম্বর আরেকটি মুখোমুখি লড়াই হয় রফিক বাহিনী ও পাকিস্তানি আর্মির মধ্যে। তিন মাইল দূর থেকে মর্টার শেলিং করতে করতে পাকিস্তানি বাহিনী এগোতে থাকে। বাবুরহাট বাজারে পৌঁছলে রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে হানাদারদের ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানি আর্মি মরিয়া হয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। চারদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে পাঁচজন পাকিস্তানি সেনাসহ বহু রাজাকার নিহত হয় এবং আল-শামসের একজন সদস্য ধরা পড়ে। পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি আর্মির কয়েকজন সদস্য গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে নিহত হয়। পাকিস্তানি আর্মির এক সেনাকে ধাওয়া করে ইসমাইল হোসেন নামের রফিক বাহিনীর এক মুক্তিযোদ্ধা একটি হেভি মেশিনগান (এমএমজি) ছিনিয়ে নেন।
পাক-ভারত যুদ্ধ হলে ৩ ডিসেম্বর বাগেরহাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি আর্মিদের খুলনায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ভারতীয় বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের একটি যৌথ দল নিয়মিত টহল দানকালে বিষ্ণপুরে রফিক বাহিনীর গেরিলাদের সহযোগী মজিবরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করলে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মজিবর ও ইসমাইল হোসেন বাগেরহাট-পিরোজপুর সড়কে অ্যামবুশ করে একটি ট্রাকে হামলা চালিয়ে দুজন ভারতীয় সেনাকে হত্যা করে।
১৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে বাগেরহাট শহরে প্রবেশ করতে থাকে। কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী শহরে অবস্থান নেয়। মেজর জয়নুল আবেদিন মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আসেন, পরে আসেন ক্যাপ্টেন নোমান উল্লাহ। রফিক বাহিনী ১৭ ডিসেম্বর পিসি কলেজে ক্যাম্প করে। রফিক বাহিনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে বন্দি করে রাখেন। এই ঘটনার পরে রফিকের নেতৃত্বে গেরিলারা পুনরায় বিষ্ণুপুরে ফিরে যান এবং পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মুজিব বাহিনীর ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে ক্যাম্পে নিয়ে যান। মুজিব বাহিনীর অশোক ও জাহাঙ্গীর পানিঘাটের কাছে রেকি করতে এলে তাদেরও আটক করে রফিক বাহিনী।
রফিক বাহিনী সে সময় ঘোষণা করে ‘জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েমের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দেশ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের কবলে পড়েছে। নতুন লড়াই শুরু হয়েছে।’ ডিসেম্বরের শেষে পানিঘাট এলাকায় ভৈরব নদীতে গানবোটে অবস্থান নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে রফিক বাহিনীর একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রফিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে ভারতীয় সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। উভয় পক্ষের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এ যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সুদূরপ্রসারী ।
১৯৭২-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে রফিকুল ইসলাম খোকন চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যান। ৩১ জানুয়ারি রাশেদ খান মেননের উপস্থিতিতে বাগেরহাট মহকুমা প্রশাসকের কাছে রফিক বাহিনী কিছু অস্ত্র জমা দেয়। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে পার্টির সিদ্ধান্তে বাগেরহাট টেনিস গ্রাউন্ডে রফিক বাহিনী তাদের সংরক্ষিত অস্ত্রের ভান্ডার আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম এ মঞ্জুর বীর-উত্তমের উপস্থিতিতে জমা দেয়।
তথ্যসুত্র : একাত্তরে বাগেরহাট : মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ ও দৈনিক সংবাদ, ডেইলি স্টার বাংলা