Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ছোট ছোট কম্পনে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা

Icon

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:২৩

ছোট ছোট কম্পনে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা

ভূম্পিকম্পের প্রতীকী ছবি

এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও ভূম্পিকম্পে কেঁপে উঠল দেশ। ৭ জানুয়ারি সকাল ৭টা ৫ মিনিটে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্পে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৬১৮ কিলোমিটার দূরে চীনের জিজাং অঞ্চলে। এর আগে ৩ জানুয়ারি হওয়া ৫ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৮২ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের হোমালিন। এক সপ্তাহে দেশে দুইবার ভূমিকম্প অনুভূত হলেও উৎপত্তিস্থল দূরে হওয়ায় বাংলাদেশে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। তবে এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভূমিকম্পের প্রস্তুতি ও পূর্বাভাস ঘিরে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ছোট ছোট এসব ভূমিকম্পে বড় বিপর্যয়ের আভাস দেখতে পাচ্ছেন। ফলে অবিলম্বে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট লাইনসহ টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান দেশটিকে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিতে ফেলেছে। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছে ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে পাঁচটি এবং রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক শূন্য এর ওপরে। এর পর থেকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প স্তিমিত হয়ে আসছে। ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের আগে এই নীরবতা থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ছোট ছোট ভূমিকম্পের পরই বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিকম্পের আঘাত উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। ২০২৪ সাল থেকে রেকর্ড করা ৬০টি ভূমিকম্পের মধ্যে তিনটি ৪.০ মাত্রার ওপরে এবং ৩১টি ৩.০ থেকে ৪.০ মধ্যে ছিল। নেপাল, ভারত, ভুটান ও চীনেও যে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, তা দুর্যোগের আন্তর্দেশীয় মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার পরও ভূমিকম্প হলে কিছুদিন এ নিয়ে চলে আলোচনা। কিন্তু ঝুঁকি মোকাবিলায় নেওয়া হয় না কার্যকর উদ্যোগ। ঢাকায় ছয় লাখ ভবনের ৬৬ শতাংশই নিয়ম মেনে হয়নি, নতুন ভবনগুলোতেও উপেক্ষিত নীতিমালা। দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বিল্ডিং কোড। ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাও লেজেগোবরে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে ঘূর্ণিঝড় গবেষণা কেন্দ্র। যন্ত্রপাতি থাকলেও ব্যবহার না করায় অকেজো হয়ে পড়ছে। দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য জরুরি পরিচালন কেন্দ্র তৈরি হলেও জনবল নিয়োগ হয়নি। ২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের পর ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। পরে চীনের সহায়তায় ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার কাজ এখনো শেষ হয়নি।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা বিভিন্ন সময় তৈরি হলেও সেগুলো অপসারণের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় না। এটি অনেকটাই চিঠি চালাচালিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তিন হাজার ২০০ ভবন চিহ্নিত করেই থেমে আছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় রাজউক। কিন্তু সেটি নকশামতো হলো কি না, ভালো মানের সামগ্রী ব্যবহার হলো কি না তা কেউ দেখে না। তিলোত্তমা এই নগরীতে লাখ লাখ ভাড়াটিয়া জানেই না, তারা যেখানে বাস করছে, তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ! আর তা জানানোর মতো কোনো সংস্থাও নেই। আবার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কি না তা জানতে বাড়ির মালিককে কী করতে হবে সে বিষয়েও সরকারের নেই কোনো প্রচারণা কিংবা কার্যক্রম।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ১৮৬৯ সালে সিলেটের কাছার এলাকায় ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে এবং ১৯২৩ সালে দুর্গাপুরেও বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ফলে সেখানে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়, যা সুপ্ত অবস্থায় আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প সেটিকে নাড়াচাড়া দিতে পারে। সম্প্রতি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি, মানে এই নয় যে, আর বড় ভূমিকম্প হবে না। তাই এক্ষুনি প্রস্তুতি নিতে হবে। ৭ মাত্রার কাছাকাছি ভূমিকম্প একশ থেকে দেড়শ বছর পর পর হতে পারে। সে হিসাবে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে যেকোনো সময় হওয়ার আশঙ্কা আছে। ঢাকা শহরের ২৫ ভাগ ভবন ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি হয়নি। কংক্রিটের মান তিন হাজার পিএসআই থাকা উচিত হলেও আছে এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার পিএসআই। রডের গুণগত মান থাকা উচিত ৭০ থেকে ৮০ পিএসআই। অথচ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে ৪০ পিএসআই। ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে কলামে ঘন ঘন রড দিতে হয়। এগুলো না মানলে ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

গত বছরের জুনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট : রাজউক অংশ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। এই ভূমিকম্প হয়েছিল টাঙ্গাইলের মধুপুরের ভূগর্ভস্থ চ্যুতি বা ফাটল রেখায় (ফল্ট)। এরপর ১৩৯ বছর হতে চললেও এত বড় ভূমিকম্প ওই ফাটল রেখায় আর হয়নি। মধুপুরের ওই ফাটল রেখায় যদি রিখটার স্কেলে (ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপক) এখন ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়, তাহলে ঢাকায় কমপক্ষে আট লাখ ৬৪ হাজার ভবন ধসে পড়বে, যা ঢাকার মোট ভবনের ৪০ শতাংশ। ওই মাত্রার ভূমিকম্প দিনে হলে কমপক্ষে দুই লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে। আর রাতে হলে কমপক্ষে তিন লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যাবে।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সমন্বিত কোনো জাতীয় নীতি নেই। যদিও একটি ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ শহর নির্মাণে এ ধরনের একটি সমন্বিত জাতীয় নীতি প্রণয়ন আবশ্যক। ভূমিকম্প সহনীয় স্থাপনা নির্মাণ এবং ভূমিকম্প সহনশীল নগরায়ণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫