-copy-6789c97107fe9.jpg)
ঢাকায় চারদিকে ধূলিকণা ভাসছে কুয়াশার মতো। ছবি: সংগৃহীত
শীতল প্রকৃতি। রাতে ঝরছে শিশির। সকাল বেরিয়েই উঁকি দেয় ঝলমলে সূর্যের আলো। এমন আলোয় চারদিক স্বচ্ছ হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু ঢাকায় চারদিকে ধূলিকণা ভাসছে কুয়াশার মতো। বুকভরে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। আড়াই কোটি মানুষের এই নগরে দূষণে মরমর প্রাণ-প্রকৃতি, হয়ে উঠছে রোগ-শোকের শহর।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ডামাডোলসহ নানা চাপা উত্তেজনায় পরিবেশগত উদ্বেগজনক এই ইস্যু গুরুত্বই পাচ্ছে না। দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের অনুপস্থিতিতে দূষণ রোধে মাঠে নেই কেউ। আগের মতো আর রাস্তায় ছিটানো হচ্ছে না পানি। দূষণে দায়ী যানবাহন কিংবা ইটভাটা চলছে দেদার। পরিবেশবিষয়ক সেমিনারে আলোচকরা অবিরাম গলা ফাটালেও কানে তুলছে না কেউ। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারি দপ্তরগুলোর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনো নেই। বায়ুদূষণ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য, সবাই সমস্যার কারণ জানেন, সমাধানের পথও জানা। তবু সমাধান নেই। বায়ুদূষণের সংকট যে মাত্রায় সংক্রমিত হয়েছে, এখনই রাশ না টানলে বিপর্যয় অনিবার্য।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো ও খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানার বিষয়গুলো ছিল। তবে সেগুলো মানা হয় না। মানাতে তেমন কোনো পদক্ষেপও দেখা যায় না। নির্দেশনা দেওয়ার পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আদালত তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন। চার বছর পেরিয়ে গেলেও মাঝে মাঝে সড়কে পানি ছিটানো ও সভা-সেমিনার ছাড়া আর কোনো কিছু করতে দেখা যায়নি। গত দুই বছরে দূষণ দূর করতে আদালত ২০ বারের বেশি রুল জারি, তলবসহ নানা নির্দেশনা দেন। গত ১৮ জানুয়ারি পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। সর্বশেষ গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অস্বাস্থ্যকর, অতি অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক বায়ু সেবন থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় অ্যালার্ট সিস্টেম চালুর মাধ্যমে জরুরি সতর্কবার্তা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে বায়ুদূষণের প্রধান কারণ চিহ্নিত করতে এবং বায়ুদূষণ কমাতে কর্মপরিকল্পনাও প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৫ নভেম্বর বায়ুদূষণের উৎস নিয়ন্ত্রণ, বায়ুমান মনিটরিং ব্যবস্থা উন্নত করা এবং আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এটি কঠোর নিয়ম বাস্তবায়ন এবং শিল্প, পরিবহন ও নগরায়ণে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তির প্রসারে একটি পথনকশা হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে লাইভ বায়ুমান দেওয়া হয়েছে। মান অনুযায়ী ওয়েবসাইটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বার্তা থাকলেও এটি বড় পরিসরে প্রচার হচ্ছে না।
মোটরযান মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় পুরোনো মোটরযান নিষিদ্ধ করতে গত ২৪ অক্টোবর ছয় মাস সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৫ সাল নাগাদ সব সরকারি নির্মাণে পোড়ানো ইটের ব্যবহার বন্ধ করতে এরই মধ্যে সরকারি অফিসে চিঠি দিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ইটভাটাজনিত বায়ুদূষণ রোধে দেশে আর কোনো নতুন ইটভাটার ছাড়পত্র দেওয়া হবে না। পাশাপাশি পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকা তিন হাজার ৪৯১টি ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এত দিন রাস্তায় পানি ছিটালেও গত ৫ আগস্টের পর থেকে তা বন্ধ আছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মেয়র, কমিশনারসহ অনেক কর্মকর্তা অনুপস্থিত। ফলে পানি ছিটানোর নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে সরকার বড় অঙ্কের টাকা খরচ করেও নগরবাসীকে নির্মল বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিতে পারেনি। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণ রোধে সরকার ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুটি প্রকল্পে অন্তত সাড়ে ছয় কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছে, যা বর্তমানে প্রায় ৭২০ কোটি টাকার সমান। এর বাইরে ছোট ছোট কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। বিশ্বের প্রভাবশালী সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ ধরনের প্রকল্পে প্রায় ২০০ কোটি (দুই বিলিয়ন) ডলারের অর্থায়ন পেয়েছে বাংলাদেশ, যা বর্তমান বিনিময়মূল্যে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার সমান। প্রকল্প নেওয়ার আগে বলা হয়েছিল, ‘দেশের বায়ুমান খারাপ।’ প্রকল্পের মাধ্যমে বায়ুকে ‘নির্মল’ করা হবে। অথচ বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকার ওপরের দিকেই থাকে ঢাকা।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই নগরের রাস্তাঘাটের ভগ্নদশা মেরামতের দায়িত্ব কারও আছে বলে মনে হচ্ছে না। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পদক্ষেপের সব সম্ভাবনা গত সরকার খসড়া নির্মল বায়ু আইনকে পাশ কাটিয়ে একটি অধ্যাদেশ প্রণয়নের মাধ্যমে আগেই হিমঘরে পাঠিয়েছে। বর্তমান সরকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত প্রচারসর্বস্ব অকার্যকর কিছু খণ্ডিত উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পেরেছে বলেও প্রতীয়মান নয়।
এ ব্যাপারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজ সরাসরি বাস্তবায়ন করার সুযোগ নেই। তবে আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনগুলোকে চিঠি দিয়েছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন রাস্তায় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে বলেছি। সবুজায়নের পরিকল্পনা নিতে বলেছি। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছি, নির্মাণসামগ্রী যাতে ঢেকে রাখা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি, বালু-সিমেন্টসহ নানা নির্মাণসামগ্রী নিয়ে ঢাকায় আসা যানবাহনগুলোকে যেন আচ্ছাদন করে আনার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে বালু না ছিটায়। বায়ুমান ঠিক রাখতে যে যে সংস্থার যা যা করণীয়, তা পালন করতে আমরা সবাইকে চিঠি দিয়েছি।