
লাল-সবুজ বায়োস্কোপ বক্স। ছবি: সংগৃহীত
চার কোনাকার লাল-সবুজ বায়োস্কোপ বক্স আর আরমান শাহের জীবন এখন একাকার। সারা দিনের সঙ্গী বায়োস্কোপ বক্সটি। যেদিন মেলা কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে সেদিন ঘুম থেকে শান্ত ভোরে উঠে পড়তে হয় আরমান শাহকে। সে হোক জনাকীর্ণ ব্যস্ত ঢাকা কিংবা গ্রামীণ পরিবেশ! এই বক্সটি নিয়েই তাকে ঘুরতে হয় দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তার আগে ঝুলিতে থাকা কম দামের মেকআপ বক্সটি খুলে মুখে লাগিয়ে তাকে সং সাজতে হয়। পরতে হয় জোড়াতালি দেওয়া বিশেষ রঙিন পোশাক। কম দামি মেকআপের গুণে একসময়ের চা দোকানি এখন পুরোদস্তুর বায়োস্কোপওয়ালা।
বায়োস্কোপ দেখানোর প্রয়োজনে আরমান শাহ শিখে নিয়েছেন পঙক্তিমালা- ‘কী চমৎকার দেখা গেল, ঢাকা শহর এসে গেল, ঢাকা শহর দেখা গেল, বাঘ আছে ভাল্লুক আছে, কলকাতারই শহর আছে, পাশে দেখেন হাওড়া ব্রিজ আছে।’
১৪ বছর ধরে বায়োস্কোপ বক্সে জীবনের চাকাকে ভর করিয়েছেন ৪৭ বছর বয়সী আরমান শাহ। গ্রামের বাড়ি তেঁতুলিয়ার বানুশাহ গ্রামে। পরিবার নিয়ে থাকেন মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকায়। তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার তার। এরই মধ্যে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, বাকি ছেলেরা স্কুলগামী।
আনন্দপ্রেমী মানুষকে বায়োস্কোপ দেখিয়েই সংসারের খরচ চালান আরমান শাহ। ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে তিনি গিয়ে থাকেন জীবিকার তাগিদে। সে ক্ষেত্রে তাকে ভাড়া দিতে হয় দিনপ্রতি সর্বনিম্ন সাত হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান, পিকনিক কিংবা মেলায় অংশগ্রহণ করতে হয় তাকে।
জীবিকার প্রয়োজনে চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য বায়োস্কোপকে আঁকড়ে রেখেছেন আরমান শাহ। এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে গেছে বিনোদনমাধ্যম। হাতের কাছে মোবাইল-ট্যাব কিংবা কম্পিউটারের চেনাজানা দুনিয়া। গুগল কিংবা ইউটিউবের উচ্চ রেজুলেশনের চোখ ধাঁধানো ভিডিও চিত্র পাল্টে দিয়েছে বিনোদনের রুচি ও অভিজ্ঞতা। ভিডিও তো নয়, চোখের সামনে যেন জ্যান্ত পৃথিবী। এই অবস্থায় বায়োস্কোপের মতো স্থিরচিত্র দেখার ধৈর্য নতুন প্রজন্মের নেই। জানান, অনেক সময় কিশোর-কিশোরীরা কৌতূহল নিয়ে বায়োস্কোপ দেখতে আসে। কিন্তু এক মিনিট দেখার পরই উঠে যায়। কারণ তাদের ভালো লাগে না।
আরমান শাহ বলেন, বায়োস্কোপের প্রতি শিশু-কিশোরদের অনাগ্রহের কারণে আমার মন খারাপ লাগে না। কিছুটা হলেও বায়োস্কোপ দেখছে, ফিরে যাচ্ছে। শিশুরা মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে ভিডিও দেখে অভ্যস্ত, বায়োস্কোপ তাদের ভালো লাগবে না, এটিই স্বাভাবিক। তবুও বায়োস্কোপ নিয়ে কেন লেগে থাকা-এমন প্রশ্নের জবাবে বায়োস্কোপওয়ালা আরমান শাহ বলেন, মানুষ একসময় বায়োস্কোপ দেখত। এখন দেখে না। তবে কেউ কেউ পুরোনো ঐতিহ্যকে মনে রেখেছে, বায়োস্কোপকে পুরোপুরি ভুলে যায়নি; এটিই আনন্দের।
অভাবের তাড়নায় পঞ্চম শ্রেণিতেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলতে হয় আরমান শাহের। এরপর বাবার হাত ধরে ঢাকায় আসা। সেই থেকেই যান্ত্রিক এই শহরে থিতু হওয়া তার।
পেশার প্রথম জীবনে মহাখালীতে চা দোকানি ছিলেন আরমান। কিন্তু পুঁজির লোকসান, ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে বেছে নেন বায়োস্কোপ জীবনকে।
বায়োস্কোপ জীবনের শুরু সম্পর্কে আরমান বলেন, বিভিন্ন মেলায় গিয়ে বায়োস্কোপ দেখতাম, বায়োস্কোপওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলতাম। তাদের সঙ্গে মিশে এখন শিখে ফেলেছি।
বায়োস্কোপের পাশাপাশি কেউ মেলার আয়োজন করতে চাইলে বিভিন্ন সরঞ্জামও জোগাড় করে দেন আরমান শাহ। তার কাছে মেলে পালকি, ঘোড়া, গ্রামীণ বাংলার ঢেঁকি, নাগরদোলা, পুতুল নাচের সরঞ্জামসহ নানা উপকরণ। মেলা কিংবা পিকনিক আয়োজকদের কাছে এগুলোর সন্ধান দিয়ে বাড়তি কিছু উপার্জন করেন তিনি।
আরমান বলেন, গ্রাম-বাংলার অনেক ঐতিহ্য তো হারিয়ে যাওয়ার পথে। কেউ চাইলে মেলা উপলক্ষে সেগুলো আমি জোগাড় করে দিতে পারি।
গ্রামীণ মেলা, পিকনিক এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে দর্শনার্থীদের বিনোদন দেওয়াই আরমান শাহের একমাত্র লক্ষ্য। জীবনের বাকি দিনগুলো তিনি কাটাতে চান বায়োস্কোপের সঙ্গে- এটিই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আরমান বলেন, বায়োস্কোপ নিয়ে আছি, এটা নিয়েই থাকতে চাই। এই জীবনই আমার আনন্দ।