
স্টপেজে দাঁড়িয়ে বহু যাত্রী, বাসের দেখা নেই। অনেকক্ষণ পর পর যদিও দু-একটা আসছে, বাদুড়ঝোলা ভিড় ঠেলে ওঠার সাধ্য কার! কারোনা পরিস্থিতির কারণে থাকা লকডাউন উঠে গেলেও পর্যাপ্ত বাসের অভাবে অন্তত মাস কয়েক এমনটাই হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা দীর্ঘদিন না চলার কারণে গাড়ির প্রায় অর্ধেক যন্ত্রাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। দ্রুত মেরামত না করলে রাস্তায় নামানো প্রায় অসম্ভব। আবার এ সময়ে বাস চালাতে সরকারের বেঁধে দেয়া কঠিন শর্তে অনেকেই পিছু হটবেন। ‘লোকসান’ এড়াতে তারা গাড়ি নামাবেন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত।
করোনাভাইরাসের কারণে গোটা দেশে থমকে রয়েছে কয়েক লাখ বাস-মিনিবাসের চাকা। এখন কত তাড়াতাড়ি সেগুলো ফের রাস্তায় নামতে পারবে, সেটি নির্ভর করছে মন্টু মিয়াদের হাতযশের ওপর। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের পাশে নিয়মিত গাড়ি মেরামত করেন তিনি। বসে যাওয়া ইঞ্জিনকে ফের কর্মমুখী করার গুরুদায়িত্বটা যে তাদের মতো মেকানিকদের ওপরেই পড়বে। একই সঙ্গে বাসের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে টায়ার-টিউব, নানা যন্ত্রাংশ, মোবিল পর্যন্ত ঢালাও বদলে না ফেললে চাকা ঘুরানো প্রায় অসম্ভব। তাই গণপরিবহন চালু হলেই বড় খরচ দেখছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা।
বাস মালিক সমিতির একাধিক নেতা জানান, প্রায় দেড় মাস ধরে সারাদেশের বাসগুলো দাঁড়িয়ে। খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায় ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে এখনই অনেক গাড়ি অচল হয়ে পড়েছে। ইঞ্জিন কাজ করছে না। দিন যত যাবে সমস্যা তত বাড়বে। ওভারহলিং ছাড়া চালানোই যাবে না। ইলেকট্রিক, টায়ার-টিউব ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হতে বসেছে। আবার এসব রাতারাতিও সারানো যাবে না। মিস্ত্রির সংখ্যা সীমিত। কাজেই সমস্যা হবেই।
গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে মিরপুর রোডে চলা ইতিহাস পরিবহনের একটি বাসের মালিক রনি তালুকদার বলেন, ‘এতদিন ধরে বন্ধ থাকায় বাসের টায়ার-টিউব নষ্ট হয়ে পড়াটা স্বাভাবিক। প্রাথমিকভাবে কাজ চললেও, সব বদলাতে সময় লাগবে এক সপ্তাহ। তাই বাসপ্রতি লাখের কাছাকাছি খরচ দেখতে পাচ্ছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি হতে পারে।’
ক্ষুধায় কণ্ঠ ক্ষীণ, দেহ শীর্ণ
একাধিক শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানান, শেষ উপার্জন হয়েছে গত ২৫ মার্চ। তারপর থেকে দেশের প্রায় ৭০ লাখ চালক, কন্ডাক্টর-হেলপার ও পরিবহন শ্রমিকের রোজগার নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের আগেই সীমিত আকারে বাস চালুর অনুরোধ জাতীয় সড়ক পরিবহন মোটর শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান মোস্তাকের। তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে লাখ লাখ পরিবহন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের কথা বিবেচনা করে ঈদের আগেই সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুর অনুরোধ জানাচ্ছি। অন্যথায় না খেয়েই মারা যাবেন অনেকে।’
এদিকে করোনাকালে সরকারি সিদ্ধান্তে গণপরিবহন বন্ধ রাখায় দৈনিক ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি মালিকদের। লোকসান পোষাতে সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছেন তারা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা জানান, গত ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই। যেসব চালক-শ্রমিক দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন, তাদের আয়-রোজগার পুরোপুরি বন্ধ। তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে ক্ষতি বিবেচনায় এ খাতের মালিক-শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দরকার।
সংগঠনের মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, করোনার কারণে পরিবহন ও সংশ্লিষ্ট খাতের ৯০ লাখ চালক-শ্রমিকের ৯৮ শতাংশই কাজ হারিয়েছেন। তবে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করা বাসপ্রতি একজন শ্রমিককে পাহারার জন্য দিনে খোরাকি বাবদ ৩০০ টাকা দিচ্ছেন মালিকরা। এ ছাড়া অটোরিকশা, লেগুনাসহ অন্যান্য যাত্রীবাহী যানের শ্রমিকরাও কর্মহীন। বেকার বসে থাকতে হচ্ছে পরিবহন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ওয়ার্কশপ-গ্যারেজ মেকানিকদেরও।
কোন পথে সমাধান
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে পরিবহন কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। পর্যাপ্ত মজুদ থাকতে হবে মাস্ক, গ্লাভস ও জীবাণুনাশক। কর্মীদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক অবস্থা নথিভুক্ত করতে হবে। যারা অসুস্থতা অনুভব করবে তাদের সঠিক সময়ে দিতে হবে চিকিৎসা। যাত্রীদের তাপমাত্রা মাপার জন্য স্টেশনে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার রাখতে হবে। যেসব যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকবে, তাদের জরুরি এলাকায় অস্থায়ী কোয়ারেন্টিনে রেখে চিকিৎসাসেবা দিতে হবে প্রয়োজন মতো। বিশ্রামাগার, বাস কম্পার্টমেন্ট ও অন্যান্য এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। টয়লেটগুলোতে থাকতে হবে তরল সাবান।
সম্ভব হলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং হাত জীবাণুনাশক যন্ত্র স্থাপন করা যেতে পারে। প্রতিবার বাস ছেড়ে যাওয়ার আগে সিট এবং বাসের মেঝে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। সিট কভারগুলোকে প্রতিনিয়ত ধোয়া, পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া অনলাইনে টিকিট কেনার পরামর্শ দিতে হবে যাত্রীদের। সারিবদ্ধভাবে ওঠা এবং নেমে যাওয়ার সময়ে পরস্পর থেকে এক মিটারেরও বেশি দূরত্ব বজায় এবং ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। ৪০ সিটের গাড়িতে বহন করা যাবে সর্বোচ্চ ২০ যাত্রী। অর্থাৎ এক আসন ফাঁকা রেখে বসাতে হবে তাদের। আর স্বাস্থ্য সচেতন করার জন্য রেডিও, ভিডিও ও পোস্টারের মাধ্যমে দিতে হবে সচেতনতামূলক বক্তব্য। যদিও এত নিয়ম মেনে বাস চালাতে আগ্রহী নয় মালিকপক্ষ।
স্বাস্থ্যবিধি বেঁধে দিয়ে ১৭ মে থেকে সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্তের পর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘জীবন যেমন জরুরি তেমনি জীবিকাও দরকার। আর এ দুটিকে সমন্বয় করতে গেলে এর বিকল্প কিছু নেই। জীবিকার তাগিদে একটু একটু করে সবই চালু করতে হবে।’ ঈদে চার দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঈদ উৎসবে সবাই গ্রামের বাড়ি যেতে চান। এর ফলে বাসে, বাসের ছাদে, ট্রেনে, ট্রেনের ছাদে, নৌকায়, লঞ্চে যে যেভাবে পারেন ছুটেন। কিন্তু এবার করোনায় দেশের পরিস্থিতি ভালো না। ঈদের সময় গণপরিবহন চালু থাকলে মানুষের ভিড় বেশি হবে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। মূলত সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে ছুটির চার দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকবে।’
এদিকে, মালিকরা হিসাব কষে দেখেছেন, বাস বন্ধ থাকলে কেবল ব্যাংকের কিস্তি দিতে হবে। আর চললে এর পাশাপাশি চালক, কন্ডাক্টর-হেলপার ও তেলের খরচ বহন করতে হবে অতিরিক্ত। সব মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচ। যেখানে যাত্রী ভাড়া থেকে ১৫ শতাংশ ওঠানোই দায়। তাই বাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকে। এ বিষয়ে পরিবহন মালিক সমিতির নেতা আরিফ খান বলেন, ‘রাজধানীতে যে বাস চলে, সেগুলো সাধারণত ৪০ অথবা ৪৫ আসনের। এখন বেঁধে দেয়া স্বাস্থ্যবিধি মানতে হলে ২০ জনের বেশি যাত্রী চড়ানো যাবে না। তার মানে আয় তো এমনিতেই অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আবার মাস্ক, গ্লাভস, জীবাণুনাশক- কত কী!’
ছিটকে পড়বেন অনেকেই
গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে রাজধানীর সদরঘাটে চলাচল করা আজমেরী গ্লোরী লিমিটেডের বাস মালিক আমিনুল ইসলাম জানান, গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও সহজে এর সংকট কমবে না। কারণ এতদিন বসে থাকায় প্রায় প্রত্যেকটা গাড়িরই ব্যাটারি ডাউন, ইঞ্জিনে সমস্যা হয়ে গেছে। তাছাড়া সিট, সিট কভার এবং বডির পেইন্টিং নষ্ট হয়ে যাওয়া তো আছেই। এখন এগুলো মেরামত করতে গেলে গাড়ি বাবদ প্রত্যেক মালিকের কমপক্ষে লাখ টাকা নতুন করে বিনিয়োগ করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘চলাচলের অনুমতি পেলেও অনেক মালিক তাদের বাস রাস্তায়ই নামাতে পারবেন না। যদিও কিছু গাড়ি নামবে এবং বসে যাওয়া ইঞ্জিনের কারণে জায়গায় জায়গায় বন্ধ হয়ে যাবে। তখন গণহারে মামলা খাবে। তা দেখে অন্যরা হয়তো গাড়ি ঠিক না করে সহজেই রাস্তায় নামাবেন না। আর এ সংকটে অনেক নতুন বা অল্প পুঁজির বাস মালিক টিকতেই পারবেন না মার্কেটে।’