
লাবণী মণ্ডল। ছবি: সংগৃহীত
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট পতন হয় তৎকালীন ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার। দেশের ইতিহাসে এটি এক নতুন বাঁক-বদল।
যদিও ছাত্র-জনতার ওপর ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া আক্রমণ চলমান থাকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত; এমনকি শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরও অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন। এসব হামলায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার। অনেকে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, হাত-পা হারিয়ে চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। আবার অনেকের মাথায় বা মেরুদণ্ডে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে চিরস্থায়ীভাবে প্যারালাইজড হয়েছে। কেউ কেউ প্যারালাইজড হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিলেও আহত-নিহতদের একটি অন্যতম অংশ শ্রমজীবী, খেটে-খাওয়া মানুষ। তাদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছে এবং ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আহতদের কান্না যেন থামছে না, প্রায়ই ওদের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দেশমাতার জন্য যারা পুরো জীবন দিতে প্রস্তুত, তারা এখন অনেকটাই অবহেলায় দিন কাটাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় নানা সহযোগিতার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়নে রয়েছে ধীরগতি।
আহতদের নিয়ে ৫ আগস্টের পর থেকেই কাজ করছেন ‘লড়াকু ২৪’-এর সংগঠক কানিজ ফাতেমা মিথিলা। তিনি বলেন, ‘যাদের রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি, তাদের যেন আমরা ভুলে না যাই। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের স্মৃতিচারণার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা সরকার এবং আমাদের সবার নাগরিক কর্তব্য। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের মাধ্যমে অব্যবস্থাপনা দূর করে মানুষের দুর্ভোগ, হয়রানির অবসান ঘটাতে হবে।’
২০ বছরের তেজোদীপ্ত তরুণ ওমর ফারুক। যার চোখে-মুখে শুধু স্বপ্ন দেখার কথা, পুরো পৃথিবীটা যার সামনে, কিন্তু এখন দিন কাটাচ্ছেন অনিশ্চয়তায়। বগুড়া সরকারি পলিটেকনিক কলেজের এই শিক্ষার্থী যেন পৃথিবীর প্রতি মায়া কমে গেছে। আন্দোলনে তিনি হারিয়েছেন অনেক বন্ধু; নিজে বেঁচে থেকেও যেন বাঁচতে পারার আনন্দ উপভোগ করতে পারছেন না। বগুড়ায় আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট পুলিশের গুলিতে তার দুটি চোখই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডান চোখ থেকে তিনটি বুলেটের অবশিষ্টাংশ সরানো হয়েছে। রিকশাচালকের ছেলে হয়েও দেশ গড়ার স্বপ্নে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে বেঁচে থেকেও কোনো কিছু দেখতে না পারার কষ্ট অনেক বেশি। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের দিনগুলো ভুলতে পারার মতো নয়। এখন কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছি না, দিন যায়, রাত আসে; কিন্তু কোনো স্বপ্ন আর দেখি না।’
জুয়েল মণ্ডলকে কল দিতেই ওপ্রান্ত থেকে নারী কণ্ঠ ভেসে আসে। ‘জুয়েল ভাই আছেন?’ বলতেই তিনি জানালেন, ও একটু বের হলো। সন্ধ্যার পর তো বের হতে পারে না। পরিচয় পেয়ে যেন নিজের ভেতরের সব ক্ষোভ, আবেগ, দুঃখ-কষ্ট ভেসে উঠল।
পাঁচজনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন জুয়েল মণ্ডল। পেশায় অটোচালক। বগুড়া শহর থেকে একটু দূরেই তাদের বাস। একটা ঘরে কয়েকজন মিলে ঠাসাঠাসি করে বাস করেন। তবুও তাদের দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। হঠাৎ জীবনের কালো অথবা উজ্জ্বলতম অধ্যায় শুরু। ৪ আগস্ট বগুড়ায় পুলিশের গুলিতে দৃষ্টিশক্তি হারান জুয়েল। মাথায় এসে লাগে টিয়ার শেল। এখন বাঁ চোখে কিছুই দেখেন না। ডান চোখে আবছা দেখতে পান। তা দিয়ে দিনের আলোয় ঘরের বাইরে যেতে পারেন। তবে এখন রাত যেন কাটতেই চায় না। রাতটা প্রায় নির্ঘুম কাটে জুয়েলের। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে আসে গুলির শব্দ, চারদিকে পুলিশের হুইসেল, ছোটছুটির শব্দ।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় জুয়েল মণ্ডলের স্ত্রী বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের চলার মতো উপায় আর নেই, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আজ অন্ধ। কোনো সহযোগিতা আমরা পাইনি, জুলাই ফাউন্ডেশনে আবেদন করেছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। আমাদের মতো পরিবার আজ দিশাহারা। আমার স্বামী ওই দিনের স্মৃতি একদম ভুলতে পারেন না। তিনি রাত-বিরাতে হুহু করে কেঁদে ওঠেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘চোখের চিকিৎসা সেভাবে হয়নি, একেক সময় একেক ডাক্তার একেকভাবে পরামর্শ দেন। ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ ঢাকা গিয়েছিলাম, ভর্তি হওয়ার জন্য; কিন্তু বললেন ভর্তি লাগবে না। ১৫ দিন পর আসেন, আবার আরেক ডাক্তার বললেন, দু-এক মাস পর আসেন। আমার স্বামী বেঁচে থাকার চিন্তা বাদ দিয়েছেন; কিন্তু আমার ছোট বাচ্চা, দেবর ও শাশুড়ি মিলে এই পরিবার। আমাদের কেন এমন নিয়তি হলো, আপা?’ কথাগুলো যেকোনো মানুষকে স্তব্ধ করে দেবে। যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
একই অবস্থা ৪ আগস্ট কারওয়ানবাজার এলাকায় পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদের। পুলিশের গুলিতে তার ডান চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। বাঁ চোখ ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। ২৬ বছরের এই তরুণ চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। অন্য ভাইদের বয়স ১০ থেকে ১৮ বছর। বাবা কিডনি রোগে আক্রান্ত। সাব্বিরেরই পরিবারের হাল ধরার কথা ছিল। এখন হতাশায় দিন কাটছে পরিবারটির।
২৮ বছরের শাহীনুর ইসলাম ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ৩ আগস্ট দুই চোখ ও কাঁধে পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দীর্ঘসময় চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। কয়েকটি সার্জারিতে ডান চোখ থেকে গুলি বের করা সম্ভব হলেও এখনো বাঁ চোখে গুলির টুকরা রয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে এমন শত শত মানুষের আত্মবলিদান মিশে রয়েছে। চোখ, হাত, পা হারিয়ে শত শত মানুষ আজ দিশাহারা। সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা নিজেও সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে আহতদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে সমালোচনা স্বীকার করেছেন। তবে সরকারের এই দায় স্বীকারই যথেষ্ট নয়। আবার এর দায় রয়েছে গোটা বাংলাদেশের মানুষেরও। আমরা যেমন ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়ার পর অকস্মাৎ বন্যার পর বানভাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম; একইভাবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের পাশে দাঁড়ানোর দায়ও আমাদের আছে, যা সহনাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য।
শাহীনুর, সাব্বির, জুয়েল, মিজানুর, অনিক শুধু এই কটি নাম নয়; বরং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের জীবন্ত প্রতীক তারা। যাদের শরীরে আজীবন বহমান থাকবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিহ্ন। এই চিহ্ন তাদের অক্ষমতা নয়, বীরত্ব। আর তাদের প্রাপ্য মর্যাদা না দিতে পারলে আমরা নিশ্চিতভাবেই মানুষ হিসেবে ছোট হয়ে যাব!