Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বিপ্লব আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে

Icon

হামযা ইবনে মাহবুব

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:২৩

বিপ্লব আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে

সমন্বয়ক হামযা ইবনে মাহবুব।

জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ফ্রন্ট লাইনের সব যোদ্ধাই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় রাজপথে ছিল। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় কেউ এইচএসসি আবার কেউ হয়তো নাইন-টেন-এ পড়তাম। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমি সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে থাকতে শুরু করি। এ হলকে বলা হতো ছাত্রলীগের ক্যান্টনমেন্ট। ফলে আমাকে হলে সক্রিয় ছাত্রলীগ করতে হয়েছে। নিয়মিত মধুর ক্যান্টিনে হাজিরা দেওয়া, প্রগ্রাম করা, সবকিছুতে আমি বেশ সিনসিয়ার ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের কাছের মানুষগুলোর একজন ছিলাম আমি। কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সবাই ছাত্র অধিকার পরিষদ করত। আমিও গোপনে ওদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, যদিও কোনো কমিটিতে ছিলাম না। বরং গোপনে তাদের নানা রকম তথ্য দিয়ে সহায়তা করতাম। তাদের বিরুদ্ধে কোনো হামলার খবর জানিয়ে দিয়ে বহুবার তাদের সম্ভাব্য মাইর খাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছি। পরে ছাত্র অধিকার পষিদ ভেঙে ‘ছাত্র শক্তি’ গঠিত হয়। আমার বন্ধুরা এর গঠনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল, আমিও তাদের সঙ্গে আগের মতো গোপন যোগাযোগ অব্যাহত রাখি। 

জুলাইয়ের প্রথম থেকেই আমি আন্দোলনে যোগ দিই। ৫ বা ৬ তারিখে আসিফ ভাই আমাকে বললেন, ‘সমন্বয়ক কমিটি করব, তুই আসবি কি না’? আমি চিন্তা করলাম, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে বা ফ্রন্টলাইনে ছিল এমন কেউ পরবর্তী সময়ে সরকারি চাকরি পায়নি। আমাদের এই আন্দোলন যদি সফল হয় তাহলেও সরকারি চাকরি পাব না, আর সফল না হলে তো কথাই নেই। সুতরাং সমন্বয়ক হতেই পারি। আমি সম্মতি জানিয়ে দিলাম। 

১৪ জুলাই রাতে ‘তুমি কে আমি কে! রাজাকার-রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!’-এই স্লোগান দিয়ে যখন হল থেকে সবাই বেরিয়ে এলো, তখনই বুঝতে পারলাম আমাদের আন্দোলন বিফল হবে না। ১৫ জুলাই হলপাড়ায় ছাত্রলীগের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় আমি আহত হই। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছাত্রলীগ পিটিয়েছিল, মাথায় ছয়টি সেলাই দিতে হয়। সেদিন আর হলে উঠিনি। শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়ে হলে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বন্ধু ওয়াহিদকে বললাম, ‘হলে থাকা তো সম্ভব হবে না, তুই কোনো ব্যবস্থা করতে পারবি কি না?’ ও সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বন্ধু নোমানকে ফোন করল। মিরপুরে ওদের একটা খালি ফ্ল্যাটে ছিল, আমি উঠলাম। আমার চিকিৎসার বিষয়টি দেখেছিল ওয়াহিদ ও নোমানের বন্ধু প্যারামেডিক্যালের ছাত্র মেহেদী। 

এর মধ্যে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিই, তিনি আমাকে তিন মাসের বেড রেস্ট দেন; কিন্তু আমি মানতে পারিনি। আন্দোলনের মধ্যে রেস্ট নেওয়া সম্ভব ছিল না।

আন্দোলন কেন করেছি, কোন তাগিদ থেকে করেছি, এটা প্রশ্নাতীত বিষয়। কোটা আমরা যারা ক্যাম্পাসে এক্টিভিজম করতাম, যেকোনো আন্দোলনের মধ্যেই আমরা চাইতাম এ আন্দোলন এমন জায়গায় যাক, যেন স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে পারি। প্রতিটি আন্দোলনে স্বৈরাচার পতনের আকাঙ্ক্ষা কাজ করত। কোটা সংস্কার আন্দোলন তো শেষ হয়ে যেতে পারত ১৫, ১৬, ১৭ তারিখ বা আদালতের রায়ের পরে। কিন্তু আমরা রায় মানিনি কেন? কারণ যখন রায় এসেছে তখন আর এটা কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল না- ছিল শহীদদের রক্তের দাম চোকানোর আন্দোলন। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, আপনি ক্ষমা চান, আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এরেস্ট করেন, আমরা আপনাদের দাবি মেনে নিচ্ছি। এ রকমটা হলে আন্দোলন শেষ হয়ে যেত, তার পতন হতো না। জুলাই-আগস্টের প্রতিটি মিনিট ছিল গুরুত্বপূর্ণ, প্রতি মিনিটে আন্দোলনের রূপ পরিবর্তন হয়েছে। 

জুলাই আন্দোলনের প্রতিটি দিন আন্দোলন শেষে রাতের সময়টিতে আমরা আইডিয়া জেনারেট করতে ব্যস্ত থাকতাম। আমি, ওয়াহিদ, নুসরাত ওয়েল কানেক্টেড ছিলাম পুরোটা সময়। আমি ওয়াহিদের এলাকায় অবস্থান করছিলাম, আর নুসরাত মিরপুর ১০-এ থাকত। ইন্টারনেট যখন বন্ধ ছিল তখন আব্দুল কাদের, রিফাত, হান্নান, মাসুদ ও মাহিন সরকারের সঙ্গে আমরা নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ করতে পারিনি। বাকি সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পেরেছিলাম। নাহিদ ভাই এবং আসিফ ভাইয়ের সঙ্গেও।  প্রায় রাতে আমরা চিন্তা করতাম, আজ পর্যন্ত এটা হয়েছে, সরকার কাল কোন কার্ডটা দিতে পারে, আমাদের ট্রাম্প কোনটা হবে- সবকিছু আমরা আগে বের করার চেষ্টা করতাম। আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল, ‘সরকারের প্রতিটি ন্যারেটিভ ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছি’। ফলে প্রতিদিন আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ত। আমাদের মনে হতে থাকে, ‘যে পরিকল্পনা করব, সেটা আমরা প্রয়োগ করতে পারব।’ 

৫ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের প্রথম এবং প্রধান আকাক্সক্ষা ছিল শেখ হাসিনার পতন। আন্দোলনের পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল, এখন যে সরকার গঠিত হবে সেটা এমন কোনো সরকার হবে না, যেটা জনগণের কল্যাণ চায় না। কারণ বাংলাদেশে যতগুলো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আছে কোনোটার ওপরই শহুরে মধ্যবিত্তের খুব একটা আস্থা নেই। আওয়ামী লীগ তো নিকট অতীতেই দেখিয়েছে, তার আগে দেখিয়েছে বিএনপি। সুতরাং এ অনাস্থার জায়গা থেকে আমরা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি, তার ওপর খুবই বীতশ্রদ্ধ। আমরা নতুন রাজনীতির দ্বারা উন্মোচন করতে চেয়েছি- এটা নিয়েই গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি কাজ করত। ৫ আগস্টের পর আমরা চেয়েছি ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে এটা হবে এবং আমরাই এ সরকার গঠন করব, কিন্তু কিছু রাজনৈতিক এবং এলিট কালপ্রিটের জন্য আমরা সফল হতে পারিনি। 

এটা আমাদের সবচেয়ে হতাশার জায়গা যে, আমরা বিপ্লবী সরকার গঠন করতে পারিনি। আমলাতান্ত্রিক যে কালচারকে ধ্বংস করতে পারিনি। পুরোনো স্টাবলিশমেন্টকে নয়-ছয় করে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে কোনো রকম- এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। 

তবে আমি মনে করি, সময় শেষ হয়ে যায়নি, সময় শেষ হয় না। আমরা যারা বিপ্লবকে বা দেশকে একটা ভালো জায়গায় দেখার আকাঙ্ক্ষা কৈশোর থেকে লালন করি- আমরা আসলে হতাশ না এই জন্য যে, আমরা মনে করি, ‘সময় শেষ হয়ে যায়নি’। আমরা বেঁচে আছি, আমাদের পরবর্তী জেনারেশন আসবে, এই বিপ্লব যদি কোনোভাবে ব্যর্থও হয়, আমার ধারণা আরেকটা জেনারেশন দাঁড়াবে। 

আমরা বিপ্লব এ জন্য করিনি যে, বিপ্লবের ফল ভোগ করে নিজেদের ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দেব। আমরা এই বিপ্লব করেছি আমাদের যে আইডিয়াগুলো আছে সেগুলো দেশ সংস্কারের জন্য আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাব। কিন্তু আসলে সত্যিকার অর্থে সে সুযোগটা আমাদের কাছে নেই, আমাদের হাতে নেই। আমরা বারবার বলছি, বিপ্লব আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, মূলত ৫ তারিখেই। ওই ছিনতাইকারী গোষ্ঠীর হাতেই সব কিছু এখন।

লেখক: সমন্বয়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫