
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নুসরাত তাবাসসুম।
জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকেই আমার অংশগ্রহণ ছিল। গণসংযোগ, বিক্ষোভ মিছিল, বাংলা ব্লকেড- সব আন্দোলনেই অংশ নিয়েছি। ১৪ জুলাই রাতে আমাদের রাস্তায় নেমে আসা, ১৫ জুলাই হামলায় আহত হওয়া, ১৬ জুলাই হলগুলোকে ছাত্রলীগ মুক্ত করা এবং চোখের সামনে এক জুনিয়রকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখা, ১৭ জুলাই হল থেকে চলে যেতে বাধ্য হওয়া এবং ত্রিমুখী হামলার শিকার হওয়া- সব বিষয় চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করা একটা অদ্ভুত অনুভূতি। যেহেতু আমি আগে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে ছিলাম, হামলা-মামলার শিকার বহুবার হতে হয়েছে। তবে অতীতের সঙ্গে এবারের পার্থক্যটা হলো- এ রকম উলঙ্গ আক্রমণ চোখে পড়েনি কখনো। তখন দেখা যেত কেবল আমরাই আহত হচ্ছি, আঘাতের শিকার হচ্ছি। কিন্তু এবার নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের আর সবাইকে হামলার শিকার এবং আহত হতে দেখা এক অদ্ভুত ক্রোধের জন্ম দেয়। আঘাতের ব্যথা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না; যতটা রাগ জন্ম নেয়। বিশেষ করে ১৬ তারিখে আবু সাঈদসহ আরো পাঁচজনের মৃত্যুর পর আমাদের আর পেছনে ফেরার উপায় ছিল না। আমরা বুঝেই গিয়েছিলাম এবার হয় বিপ্লব, না হয় মৃত্যুর মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছি।
১৭ তারিখে এক অদ্ভুত অনুভূতি। এদিন বিকেলে হল থেকে বেরিয়ে পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে গিয়েছি। এই কান্না বেদনার ছিল না, অন্য রকম একটা আফসোসের, অনেকটা হাত কামড়ে ধরার মতো। মনে হয়েছিল, আবার ফেরত আসব। কিন্তু সংশয়ও ছিল, আদৌও আসতে পারব তো? আমাকে ওই দিন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় ধরে ঘুরে ঘুরে একটা সেফ জায়গায় যেতে হয়েছে। মোড়ে মোড়ে দেশের পতাকা কারো কাছে দেখলেই আন্দোলনকারী বলে মারা হচ্ছিল। সার্চ করে দেখা হচ্ছিল ভার্সিটির আইডি কার্ড। আমি লুকিয়ে ব্যাগে আইডি কার্ড, পতাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম এগুলো দেখলে নির্যাতনের শিকার হতে পারি, কিন্তু তার পরও আমি রেখে আসিনি। ওই সত্তাটা আমার সঙ্গে ছিলই।
এটা ভেবেও ভালো লাগে, যেকোনো কিছুই আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে পারেনি। এমনকি ১৮ তারিখের পর আমি যখন আত্মগোপনে মিরপুরে ছিলাম, তখনো লুকিয়ে লুকিয়ে মাস্ক পরে আমি আন্দোলনে গিয়েছি। ওই পরিস্থিতিতে এ ছাড়া কিছু করার উপায় ছিল না।
ব্লাক আউটের সময় সবচেয়ে চিন্তা ছিল সহযোদ্ধারা কে কোথায় আছে, খবর নিতে পারছি না। সব সময় ফোন চালু রাখতে হতো। ওই সময় প্রতিদিন প্রায় পাঁচশ করে কল আসত। প্রথমবার নাহিদ ভাই গুম হওয়ার পরের দিন প্রায় দেড় হাজার কল এসেছিল।
আমরাও কিন্তু ফোনে ফোনে টেক্সট করে ৯ দফার ঘোষণা লিখেছিলাম। সবার সঙ্গে হয়তো যোগাযোগ করতে পারিনি। কিন্তু যারা একটিভ ছিলাম, তারা মিলেই করেছিলাম। কিন্তু ওটা আমরা মিডিয়া হাউসগুলোতে পাঠাতে পারিনি। সৌভাগ্যক্রমে যেহেতু ভাষা একই ছিল, আব্দুল কাদেরের হাত ধরে শেষ পর্যন্ত তা জনগণের কাছে পৌঁছে।
আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম, কিন্তু তার পরও কোনো না কোনোভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটা রক্ষা করতে পেরেছি। যেমন ধরা যাক, আমার সঙ্গে পাঁচজনের যোগাযোগ আছে, তার সঙ্গে হয়তো পৃথক পাঁচজনের যোগাযোগ, এভাবে এক দিনে না হোক, দুই দিনে আমরা সবার খোঁজ পেয়ে যেতাম।
এরপর অবশ্য এক হতাশার সময় পার করেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হতে থাকে, এভাবে মানুষ, খুন-গুম হয়তো কোনো দিন শেষ হবে না। নিজেদেরও দোষী মনে হতো, আমরা যদি আন্দোলন শুরু না করতাম, তাহলে হয়তো এত মানুষ খুন হতো না। তারপর তো নিজেই গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম।
২৮ জুলাই আমাকে যখন গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ ওরা আমার ফোনটা নিয়ে নিয়েছিল। এটা ব্যবহার করে তাদের পক্ষে আমার সহযোদ্ধাদের গ্রেপ্তার করার আশঙ্কা ছিল। আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে আমাকে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাওয়ার আগেই আমার অন্তত তিন সহযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করা হবে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার পরে এদের কাউকে আর গ্রেপ্তার করা হয়নি। কারণ এদের সবাই গ্রেপ্তার হলে পরবর্তী সময়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে যেত।
গ্রেপ্তারের পরের ওই দিনগুলো ভাবতে গেলে এখন আর তেমন কিছুই মনে পড়ে না, এতটাই ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম।
বহুদিন পর্যন্ত আমি ভোর ৫টা না বাজলে ঘুমাতে পারতাম না। আন্দোলনের সময়গুলোতে প্রায় সারারাতই আমাদের জেগে থাকতে হতো, হয়তো রাতে ঘণ্টাখানেক ঘুমানোর সময় পেতাম। কেবল ওই দিনই আমার ওপর অর্পিত সব দায়িত্ব শেষ করে, একটু আগে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এর দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমি গ্রেপ্তার হই। ফলে ঘুম হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে আতঙ্কের মতো। মনে হতো ঘুমাতে গেলেই আবার কোনো বিপদ আসবে। এই কারণে আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম, চিকিৎসাও নিতে হয়েছে।
এরপর আসে স্মরণীয় পাঁচ জুলাই। বিজয়ের পরের অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আমরা স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছি, কিন্তু কখনো মনে হয়নি যুদ্ধটা শেষ হয়ে গেছে। বিজয়ের পরেই একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সরকার গঠন হলো। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা। আমরা সব কিছুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম, সব সময়েই মনে হচ্ছিল একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। এখন অবশ্য সব কিছু শান্ত হয়ে আসছে। মানুষ এখন প্রশ্ন করতে পারছে। ফলে খুব শিগগিরই আর কারো পক্ষে বেপথে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি, এটা সত্য। কিন্তু আমরা একটা ইতিহাস গড়তে পেরেছি। এটাই আমাদের সফলতা। আগে উন্নয়ন ছিল এক ধরনের কল্পকথার মতো। কিন্তু এখন সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পারি কতটা এগোচ্ছি বা এগোতে পারছি না। সব মিলিয়ে আমি এই দেশ নিয়ে ভীষণ আশাবাদী।
নুসরাত তাবাসসুম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।