Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

হিল্লা বিয়ে ও প্রচলিত আইন

Icon

লোকমান হাওলাদার

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৪৪

হিল্লা বিয়ে ও প্রচলিত আইন

প্রতীকী ছবি

গাজীপুরের শ্রীপুরে সম্প্রতি হিল্লা বিয়ে দিয়ে মসজিদের ভেতরে এক নারীর সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষককে শারীরিক সম্পর্কের সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক ইমামের বিরুদ্ধে। হিল্লা বিয়ের নামে মাঝে মধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনিয়মের ঘটনা ঘটে। হিল্লা বিয়ে দেশের প্রচলিত আইনবিরোধী। তালাকের পর নিয়ম মেনে একই ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে করতে আইনে বাধা নেই। মুসলিম আইনে এ ব্যাপারে যথাযথ বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। নানা মুনির নানা মত নিয়ে শরিয়া নিয়মের অজুহাত দেখিয়ে কারো কারো দাম্পত্য জীবন বিষিয়ে তোলা হয়। 

মূলত হিল্লা বিয়ে হচ্ছে তালাক হওয়া একই নারী বা পুরুষের মধ্যে পুনরায় বিয়ে হওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কাছে একটি নিয়মের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া। ২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ এ জাতীয় হিল্লা বিয়ে ফতোয়াকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেছেন। হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে এই রায়ে বলা হয়েছে, হিল্লা বিয়ের ফতোয়া হচ্ছে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা নম্বর ৭ এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা নম্বর ৪৯৪, ৪৯৮, ৫০৮ ও ৫০৯ লঙ্ঘন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ নম্বর ধারাটি সমাজে কতটুকু মানা হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে সাধারণ জনগণ বা কথিত ইসলামী চিন্তাবিদরা কতটুকুই জানে।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭-এ বলা আছে, কেউ যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তাহলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত নোটিশ প্রদান করতে হবে এবং এর একটি কপি স্ত্রীকে দিতে হবে। ৭ ধারায় বলা হয়েছে, নোটিশ জারির ৯০ দিন অতিবাহিত না হলে তালাক কার্যকর হবে না। পূর্ণভাবে তালাক কার্যকর হওয়ার পর স্ত্রী যদি স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চান, তবে কাবিনের মাধ্যমে যথাযথ আইনগত পদ্ধতি মেনে পুনরায় বিয়ে করলেই হবে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে সাময়িক বিয়ের প্রয়োজন নেই এবং তা তিনবার পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে। 

তবে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে হিল্লা বিয়ের কিছু সংশোধিত বিধি লিপিবদ্ধ আছে। দম্পতির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালাক হয়ে যাওয়ার পর যদি উভয় পক্ষ মনে করে তারা পূর্বাবস্থায় ফিরতে ইচ্ছুক, তবে বিয়ের কাবিন মোতাবেক তৃতীয়বার পর্যন্ত পুনর্বিবাহ করা যায়। কিন্তু তৃতীয়বারের পরে হিল্লা বিয়ের প্রয়োজন হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের কিছু বিধান নিয়ে মতভেদও রয়েছে। কিন্তু এই আইনের একটি ধারায় বলা আছে, এ আইন দেশে বলবৎ অন্য যেকোনো আইন বা প্রথা থেকে প্রাধান্য পাবে। 

ইসলাম ধর্ম মতে, ধর্মীয় আইনবিশেষজ্ঞ বা ফিকাহশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা ফতোয়া দিতে পারেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে যখন শরিয়ত সম্পর্কিত অনুশাসনগুলোতে কোনো জটিল প্রশ্নের সরাসরি মীমাংসা পাওয়া যায় না, তখন মুফতিরা সাধারণত ফতোয়ার মাধ্যমে পূর্ববর্তী নজির এনে সমাধান দেন। বর্তমানে যেসব ফতোয়া জারি করা হচ্ছে, তার মধ্যে দোররা মারা, পাথর ছুড়ে মারা, জুতাপেটা, মাথার চুল কেটে দেওয়া, বেঁধে পেটানো, মাটিতে অর্ধেক পুঁতে পাথর ছোড়া, হিল্লা বিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। তবে এসব নির্দেশ কোনো মতেই ফতোয়ার সুস্পষ্ট সংজ্ঞাকে সমর্থন করে না। সব ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত যেসব বিধান আছে এর ২৭, ২৮, ৩১ ও ৩৫ অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন। ২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের বেঞ্চ থেকে ফতোয়াকে যে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়, তা এক দম্পতির মৌখিক তালাক ও হিল্লা বিয়েকে কেন্দ্র করে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া হয়। 

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মতামত সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা একমাত্র আদালতেরই আছে। ফতোয়াবাজির ঘটনাকে আমলে নিতে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের প্রতি নির্দেশ, স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে সব স্কুল ও মাদ্রাসায় পারিবারিক আইন পাঠ বাধ্যতামূলক করা প্রভৃতি। এসব ফতোয়া বাংলাদেশের বিধিবদ্ধ ১৯৬১-এর মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ ধারার বহির্ভূত এবং এ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়, এসব ফতোয়া বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনসহ বিভিন্ন আইনের লঙ্ঘন করা হচ্ছে। রায়ে বলা হয় তিনবার ‘তালাক’ বললেই বিবাহবিচ্ছেদ হয় না। এই চর্চা কোরআন, হাদিস এমনকি মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ (ধারা-৭) এরও বিরোধী। 

বাংলাদেশে হিল্লা বিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ ও আইনত দণ্ডনীয়। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ৭(৬) ধারা অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে, তালাক হওয়া দম্পতি আবার বিয়ে করতে চাইলে পুনরায় বিয়ে করতে পারবে। কোনো হিল্লা বিয়ের প্রয়োজন নেই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫