Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

শীতের আয়ু ও তীব্রতা কম: নেতিবাচক প্রভাব কৃষিতে

Icon

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৮

শীতের আয়ু ও তীব্রতা কম: নেতিবাচক প্রভাব কৃষিতে

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই আবহাওয়ার পরিবর্তন।

মাঘ মাস শেষের দিকে, তবু শীতের তেমন দেখা নেই। দিনের বেলা ঘরের বাইরে বের হলে উল্টো সূর্যের প্রখরতা শরীর পুড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতি বছর তীব্র শৈত্যপ্রবাহে দেশের মানুষ নাস্তানাবুদ হলেও এবার তা দেখা যায়নি। শীতের সময়কালও কমে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শীতের তীব্রতা ও বিস্তার কমার ফলে সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। ফসলে রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক উৎপাদন ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও ঋতুবৈচিত্র্যের পরিবর্তনের ফলে কৃষি, উপকূলীয় অঞ্চল, পানিসম্পদ, বনাঞ্চল, মৎস্য, স্বাস্থ্য ও জ্বালানি খাত বেশি বিপন্ন হতে পারে। শীত কম পড়লে ফসলে ফুল কম ফোটে, আবার কিছু ফসল দ্রুত পরিণত হয়ে যায়। তখন এর ফলন কমে। এমন পরিস্থিতিতে আবহাওয়ার গতিবিধির সঙ্গে মিলিয়ে জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের তাগিদ দিয়ে তারা বলছেন, ঝুঁকি কমাতে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছে শীতকাল

বাংলা ঋতুচক্রে ছয় ঋতুর কথা বলা হলেও আবহাওয়াবিদদের হিসাব এর চেয়ে ভিন্ন। তাদের কাছে ঋতু হচ্ছে চারটি- বর্ষাপূর্ব, বর্ষা, বর্ষা-পরবর্তী সময়কাল ও শীত ঋতু। এর মধ্যে শীতকাল ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এবার বছরের শুরুতে সপ্তাহখানেক কিছুটা শীত অনুভূত হয়েছিল। তার পর থেকে শীতের বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। গ্রামাঞ্চলে ভোর ও রাতে কিছুটা শীত অনুভূত হলেও শহরাঞ্চলে শীত নেই বললেই চলে। মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহে এসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, শীতলতম মাস জানুয়ারিতে দেশে একটিও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। যদিও প্রতি বছর অন্তত একটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয় এ মাসে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহহীন জানুয়ারি দেখা গিয়েছিল ৯ বছর আগে, ২০১৬ সালে। এবার জানুয়ারিতে গড় তাপমাত্রাও ছিল অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি, বিপরীতে কুয়াশা কম পড়েছে। এভাবে শীত কমে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত, যা নানা দিক দিয়ে সংকট তৈরি করতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে ২০২৪ সালে চারটি, ২০২৩-এ একটি এবং ২০২২ ও ২০২১ সালে তিনটি করে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়েছিল। এই মৌসুমে একটিও তীব্র শৈত্যপ্রবাহের দেখা মেলেনি। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, এ বছর গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একই অবস্থা। এ অঞ্চলে চলতি বছরে তেমন দীর্ঘ কিংবা তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ছিল না। এর অনেক কারণের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম।

আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এবার জানুয়ারি মাসজুড়ে বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য ছিল। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জানুয়ারি মাসে স্বাভাবিক শীত পড়েনি। স্থানীয় প্রভাবের সঙ্গে টেলি-কানেকশনের কারণে আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবহাওয়ার এমন বৈরিতার কারণ অনুসন্ধানে আরো গবেষণা করতে হবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ১৯৭১ থেকে ২০০০- এই ৩০ বছরে বাংলাদেশের যে তাপমাত্রা এবং ১৯৯১ থেকে ২০২০ এই ৩০ বছরের তাপমাত্রা তুলনা করলে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে সারা বছরের তাপমাত্রাই বেড়েছে ও বৃষ্টিপাত কমেছে।

আবহাওয়াবিদ ড. বজলুর রশীদ বলেন, মূলত দুই ভাবে দেশের অভ্যন্তরে শীতের বাতাস প্রবেশ করে। একটি দিক হচ্ছে কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ হয়ে উত্তরবঙ্গ দিয়ে; আরেকটি অংশ প্রবেশ করে চীন হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে। এই বাতাস বয়ে নিয়ে আসে পশ্চিমা লঘুচাপ। এবার ভূমধ্যসাগর থেকে এই বাতাস ভারত হয়ে আসার সময় অধিক জলীয়বাষ্প নিয়ে আসে। ফলে ওপরের বাতাস নিচে নামতে বাধা পায়। যে কারণে শীত স্থায়ী হতে পারছে না।

আবহাওয়ার হেঁয়ালি আচরণে ধুঁকছে কৃষি

দেশে ফসলের সবচেয়ে বড় মৌসুম রবি। বোরো ধান, গম, ভুট্টা, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, শীতকালীন সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদন হয় মৌসুমটিতে। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে ফসলের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণের কারণে ফসলে রোগবালাই বাড়তে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) শস্য উৎপাদন শাখার পরিচালক শওকত ওসমান বলেন, শীতের ব্যাপ্তি যে কমে আসছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর ব্যাপ্তি কমে আসায় শীতকালীন ফসলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শীত কম পড়লে গম, আলু ও সর্ষের মতো ফসলের ফুল কম ফোটার আশঙ্কা থাকে। গমের ক্ষেত্রে তাপসহিষ্ণু জাতের বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু আলু বা সর্ষের তা নেই। তাই এসব ফসল এবার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ দাউদ হোসেন বলেন, প্রতিটি ফসলের একটা নির্ধারিত তাপমাত্রার স্তর থাকে। শীতকালীন ফসলগুলোর জন্য (আলু, গম, ভুট্টা, সরিষা, টমেটো প্রভৃতি) তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে টানা আড়াই মাস থাকতে হয়। এই সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সব ফসলের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন কমে আসবে। তিনি বলেন, তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ফসলটি দ্রুত পরিণত হয়ে যায়। তখন এর ফলন কমে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী মৌসুমে ধীরে ধীরে কৃষক ওই ফসলের আবাদ থেকে সরে আসে। আর এ কারণে দেশে গমের উৎপাদন কমে গেছে।

শীতকালীন ফসল সবচেয়ে বেশি হয় রাজশাহী এলাকায়। রাজশাহী বিভাগীয় অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ সামছুল ওয়াদুদ বলেন, এটা ঠিক যে শীতের ব্যাপ্তি কমে যাওয়ায় বিগত বছরগুলোতে গমের চাষ কমে গিয়েছিল। তবে এখন আটার দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার থেকে মানুষ গমের চাষ আবার শুরু করেছে। কিন্তু শীতের ব্যাপ্তি কম থাকায় গমসহ শীতকালীন ফসলগুলোতে ফলন কম হবে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

মুন্সীগঞ্জের কৃষক আব্দুর রহমান আড়াই বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এবার খুব একটা শীত নেই। তাই আলুর গাছ ভালো হলেও রাতে শীত দিনে গরমের কারণে আলুর আকার ছোট হয়ে গেছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, রাতে ঠান্ডা আর দিনে গরম এমন আবহাওয়া ধানের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। তখন বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রির বেশি হলে ব্লাস্ট প্রকট হতে পারে। পরিকল্পিতভাবে ফসল উৎপাদন করা গেলে ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ কৃষি থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। সমস্যা মোকাবিলা এবং ঝুঁকি কমাতে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। আবহাওয়ার হেঁয়ালি আচরণে যেসব ফসলের ক্ষতি হচ্ছে সেসব কৃষককে সহায়তা দিতে হবে। সেটা ভর্তুকির কিংবা বিমার মাধ্যমে। বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তা দিতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫