
প্রতীকী ছবি
ইউনুস মিয়ার (ছদ্মনাম) বয়স ৩০ বছর। ছোটবেলায় তাকে দত্তক নেন করিম আলী নামের এক ব্যক্তি। ইউনুস মিয়ার সব কাগজপত্রে মা-বাবার নামের জায়গায় পালক মা-বাবার পরিচয় দেওয়া। এর মধ্যে পালক বাবা হঠাৎ মারা যান। তার মৃত্যুর পর ইউনূস মিয়া জানতে পারেন পারিবারিক ওয়ারিশনামায় তার নাম নেই। পারিবারিক আইন বিষয়েও তিনি অবগত নন। ওয়ারিশনামায় যেহেতু তার নাম নেই তাই পালক মা-বাবার কোনো সম্পত্তি তিনি পাবেন না। তাই আইনি কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন।
দেশে অনেক নিঃসন্তান দম্পতি আছেন। তাদের অনেকে সন্তানের অভাব পূরণ করতে শিশু দত্তক নিতে চান। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ইচ্ছা থাকলেও অনেকে আইনি জটিলতার কারণে দত্তক নিতে পারেন না। শিশু দত্তকসংক্রান্ত আইনের সুনির্দিষ্ট এমন কোনো বিধান বাংলাদেশে নেই, যাতে একটি শিশু পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে অভিভাবকত্ব অর্জন করলে শিশুকে নিজের জিম্মায় রাখা যায়, এটি পুরোপুরি মাতৃ-পিতৃত্ব নয়।
১৯৮৫ সালের পারিবারিক আইনের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি অভিভাবক হিসেবে একটি শিশুর দায়িত্ব নিতে পারেন। সেটা অবশ্যই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিতে হবে। ১৮৭৫ সালের মাইনরিটি অ্যাক্টের ৩ ধারা অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুর জন্য ১৮৯০ সালের অভিভাবকত্ব ও পোষ্য (গার্ডিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট) আইনের ৭ ধারায় কাস্টডি নেওয়া সম্ভব। সেটা নিতে চাইলে ১৯৮৫ সালের ফ্যামিলি কোর্ট অর্ডিন্যান্সের এখতিয়ারভুক্ত পারিবারিক আদালতে আবেদন করতে হবে। কোনো শিশুর অভিভাবকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়াটি জটিল। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে আদালত রায় দেন। গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ অনুসারে কোনো দম্পতি চাইলে শিশুর অভিভাবকত্ব অর্জন করতে পারেন। সেটাও মাতা বা পিতা হিসেবে নয়, একজন অভিভাবক হিসেবে। তাই অভিভাবকত্ব আর দত্তক এক বিষয় নয়। তবে বাংলাদেশের মানুষ অভিভাবকত্ব নেওয়াকেই দত্তক বলে মনে করে থাকে।
গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ অনুসারে শুধু বাংলাদেশি নাগরিকরা কোনো শিশুর অভিভাবকত্ব নিতে পারবেন। কারো যদি দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকে, তাহলে তার অন্তত একটি নাগরিকত্ব বাংলাদেশের হতে হবে। অন্যথায় অভিভাবক বা সন্তান, কেউই এই আইনের এখতিয়ারভুক্ত হবেন না। এবার সম্পত্তির প্রসঙ্গে আসা যাক। কোনো দম্পতি কোনো শিশুর অভিভাবকত্ব নিলেও ওই শিশু তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বিবেচিত হবেন না। মুসলিম আইনে দত্তক সন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। তবে বিকল্প ব্যবস্থাও আছে। মুসলিম আইন অনুযায়ী উইলকে বলে অছিয়ত। সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক কোনো মুসলমান তার অনাত্মীয়কে অর্থাৎ যিনি তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন না, তাকে সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত অছিয়ত করতে পারেন। কাজেই ইউনুস মিয়ার বর্তমান মা (যে তাকে পালক নিয়েছেন) চাইলে তার সম্পত্তির একটি অংশ অছিয়ত করতে পারেন।
তবে ইউনুসের জন্মদাতা মা-বাবার সম্পত্তি থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন না। আইনগতভাবে তার জন্মদাতা মা-বাবার সম্পত্তি থেকে তিনি অংশ দাবি করতে পারবেন। যেহেতু তিনি তাদের বৈধ উত্তরাধিকার। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশের পর হিন্দু আইনে পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে দত্তকের বিষয়টি আইনসিদ্ধ। মানে এই আইনের অধীন শুধু ছেলেশিশু দত্তক নেওয়া যাবে। হিন্দু পুরুষ বিবাহিত, অবিবাহিত বা বিপত্মীক, যা-ই হোক না কেন, দত্তক নিতে পারবেন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে এই অধিকার সীমিত। একজন অবিবাহিত নারী সন্তান দত্তক নিতে পারেন না। বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি দরকার। এমনকি বিধবা হিন্দু নারী সন্তান দত্তক নিতে চাইলে তাকে স্বামীর মৃত্যুর আগে দেওয়া অনুমতি দেখাতে হবে।