Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

জলবায়ু উদ্বাস্তু: বাস্তবতা ও টেকসই সমাধান

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১৩:১১

জলবায়ু উদ্বাস্তু: বাস্তবতা ও টেকসই সমাধান

প্রতীকী ছবি

জলবায়ু পরিবর্তন বলতে শুধু উষ্ণতা বৃদ্ধিই বোঝায় না, এর পেছনে লুকিয়ে থাকে হাজারো বাস্তুচ্যুত মানুষের আর্তনাদ, আছে নিজের পরিচিত ঠিকানা হারানোর কষ্ট আর কিছু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গল্প। জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসনের একটি প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খরার প্রকোপের ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারাচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে আনুমানিক ২১৬ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হতে পারে।   

জলবায়ু উদ্বাস্তু কী

জলবায়ু উদ্বাস্তু হলো সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশগত বিপর্যয় বা প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তাদের নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে এই সংকটের নির্মম বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করছে। উপকূলীয় অঞ্চলে নদীভাঙন, লবণাক্ততার বিস্তার এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাজার হাজার মানুষকে তাদের জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য করছে। তারা আশ্রয়ের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে, যা নগরায়ণের ওপর তীব্র চাপ তৈরি করছে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক নতুন নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। আর চেনা পরিবেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য মানুষদেরই মূলত ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ (climate Refugee) বলা হয়।

বাংলাদেশের বাস্তবতা

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ও বন্যার কারণে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। ২০২৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ডিজাস্টার ডাটাবেইসের (EM-DAT) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়েছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা ও পটুয়াখালীর উপকূলীয় এলাকার অনেক পরিবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে তাদের জমি হারিয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার মতো শহরগুলোতে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।  

বাস্তুচ্যুতির হার কেমন

অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইডিএমসি) তথ্য অনুসারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের বার্ষিক বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা ৯ লাখ ১৫ হাজার। চলতি শতকের শুরুর দশকে এই সংখ্যা ছিল গড়ে সাত লাখ।

আইডিএমসির সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্টে বলা হয়েছে, গত বছর (২০২৪) অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে পঞ্চম। সংখ্যাটা ১৭ লাখ ৯১ হাজার। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ১৫ লাখ, ২০২১ সালে প্রায় ১০ লাখ, ২০২০ সালে দুর্যোগের কারণে প্রায় ৪৪ লাখ, ঘূর্ণিঝড় ফণী ও বুলবুলের কারণে ২০১৯ সালে ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

আইডিএমসির তথ্য বলছে, উপকূলীয় জেলা, যেমন- ভোলা, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরার মতো জেলাগুলো থেকে বাস্তুচ্যুতি বেশি ঘটে। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের বছরগুলোতে বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা বেড়ে যায়। যেমন- ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ফলে ২৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। তবে তাদের বেশির ভাগই আবার নিজেদের জায়গায় ফিরে গেছে।

কোথায় যাচ্ছে বাস্তুচ্যুতরা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের যেসব এলাকায় কাজের সুযোগ আছে, সেসব এলাকায়, বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলো এবং কখনো দেশের বাইরে অভিবাসন নিচ্ছে বাস্তুচ্যুতরা। ফলে শহরগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার মহাপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা ৩.৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মেয়রস মাইগ্রেশন কাউন্সিল বলছে, রাজধানীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসন।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা অভিবাসন নিচ্ছে তাদের প্রায় ৬০ শতাংশ রাজধানী ঢাকা, ২০ শতাংশ চট্টগ্রাম শহরে ও ২০ শতাংশ আন্ত জেলায় অভিবাসী হচ্ছে।

আধুনিক দাসত্বের ফাঁদ

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের একটি বড় অংশ কর্মসংস্থানের অভাবে মানব পাচার ও শ্রম শোষণের শিকার হচ্ছে। ট্রান্সন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের (TNI) এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ স্বল্প মজুরির শ্রমে যুক্ত হচ্ছে, যেখানে তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।  

কী হতে পারে সমাধান?

আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ রেখে যাওয়ার জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে মানুষ যাতে ঢাকামুখী না হয় সে জন্য স্থানীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সঠিক কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং এটি সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। আইনগত পদক্ষেপের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করতে হবে। বিকল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে দ্রুত ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল প্রদান করতে হবে। এ তহবিলের একটি অংশ জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে ব্যয় করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মানবাধিকার আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের আইনি স্বীকৃতি, সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদানের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা দরকার। সদস্য দেশগুলোকে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করা উচিত এবং প্রতিটি দেশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কমানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বোপরি জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিটি দেশের সরকারকে সক্রিয় হতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনে শুধু আবহাওয়ার রূপরেখা বদলাচ্ছে না, এটি আমাদের অর্থনীতি, জনসংখ্যার ভারসাম্য, মানবাধিকার ও উন্নয়নের গতিপথকেও আমূল পরিবর্তন করছে। এই সংকটের সমাধান কেবল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের প্রয়োজন বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ, যেখানে অভিযোজন, পুনর্বাসন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকবে একসঙ্গে। উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে টেকসই অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেন জনবসতি বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে। কৃষিকে করতে হবে জলবায়ু-সহনশীল, আর নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। তবে শুধু অবকাঠামো বা প্রযুক্তি দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। মানুষের জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রাখতে হলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য সুষ্ঠু পুনর্বাসনব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন জীবনে স্থিতিশীলতা পেতে তাদের সহায়তা প্রয়োজন, যাতে তারা নতুন সমাজে নিজের জায়গা করে নিতে পারে। এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে এটি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। তাই এখনই সময়, সমাধানের পথ খুঁজে নেওয়ার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫