ইউনূসের সমালোচনা: রাষ্ট্রদূত হারুন ও পরিবারের পাসপোর্ট বাতিল

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ২০:৪২

মোহাম্মদ হারুন আল রশিদ। ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেছেন’ বলে অভিযোগ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় মরক্কোয় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হারুন আল রশিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার।
এরই মধ্যে হারুন ও তার পরিবারের পাসপোর্ট বাতিলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য দেওয়া হয়।
হারুনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১১ ডিসেম্বর দেশে প্রত্যাবর্তন ও অনতিবিলম্বে মন্ত্রণালয়ে যোগদানের জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে এতে বলা হয়, “কিন্তু তিনি পদে বহাল থেকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব ত্যাগ করেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার বদলে বিভিন্ন অজুহাতে যাত্রা বিলম্বিত করেন।”
অনুমোদন ছাড়াই হারুন মরক্কোর রাবাত থেকে কানাডার অটোয়ায় চলে গেছেন বলে জানতে পেরেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত ৬ মার্চ তার অটোয়া থেকে ঢাকায় ফিরে আসার কথা থাকলেও তিনি ফেরেননি।
হারুন সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করছেন জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, শুক্রবার তার ফেসবুক প্রোফাইলে ইংরেজিতে একটি পোস্ট দেন যার শিরোনাম ছিল: বাংলাদেশ ও আমার জন্য একটি আকুল আবেদন: ইউনূসের অধীনে বাংলাদেশের নৈরাজ্যে পতিত হওয়ার মধ্যে বিশ্বের নিরবতা বেদনাদায়ক’।
পোস্টে রাষ্ট্রদূত হারুন আওয়ামী লীগ সরকারের গুণকীর্তনের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গত ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে পরিস্থিতি ক্রমশ নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে চিত্রিত করার অপচেষ্টা করেছেন বলে মন্তব্য করেছে মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “পোস্টে জনাব হারুন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করেছেন।”
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বর্তমান বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতি এবং বাস্তবতাকে সম্পূর্ণরূপে বিকৃত উপস্থাপন করার অভিযোগ এনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “ফেসবুকে এ ধরনের লেখা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং এর বিষয়বস্তু গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এরূপ রচনা লেখকের গোপন উদ্দেশ্য বা অসৎ অভিসন্ধির ইঙ্গিত দেয়।“
কানাডায় চলে গিয়ে রাষ্ট্রদূত হারুন ফেসবুক পোস্টে নিজেকে 'নির্যাতিত কূটনীতিক', 'নির্বাসিত ঔপন্যাসিক' ও 'ধর্মনিরপেক্ষ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “যা মূলত বিদেশে সহানুভূতি অর্জনের অভিপ্রায়ে করা হয়েছে।”
হারুন যা লিখেছেন
হারুনের পোস্টে দাবি করা হয়, মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে ছড়িয়ে পড়া বর্বরতার কবলে কাতরাচ্ছে।
“লক্ষ লক্ষ মানুষ একটি অসম্ভব পছন্দের মুখোমুখি: মৃত্যু, নির্বাসন, অথবা চরমপন্থি উগ্রবাদের কাছে আত্মসমর্পণ।”
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈধ সরকারকে “সুপরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা’ চালিয়ে উৎখাত করা হয়েছে দাবি করে তিনি লেখেন, “দেশের ভিত্তি ভেঙে দিয়েছে। দেশ যখন জ্বলছিল এবং শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছিল, মুহাম্মদ ইউনূস একজন ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে আবির্ভূত হন।”
‘একটি সন্ত্রাসী আন্দোলনের উত্থান: একটি পরিকল্পিত পরিকল্পনা’ উপশিরোনামে পিনাকী ভট্টাচার্য এবং ইলিয়াস হোসেনের মতো ইউটিউবাররা পশ্চিমা দেশগুলোকে তাদের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে ‘উগ্রবাদ এবং ম্যানিপুলেশন ছড়িয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেন হারুন।
তিনি লেখেন, “তারা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অনলাইনে যুদ্ধ চালিয়েছে, মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে এবং অশান্তি উসকে দিয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার এবং বামপন্থি জাহেদুর রহমানকে ‘জিহাদি’ উল্লেখ করে হারুন লেখেন, “বাংলাদেশের ভেতরে শেখ হাসিনার মুক্ত মত প্রকাশের প্রতিশ্রুতিকে অপব্যবহার করে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাদের প্রচারণা হিন্দু ও ভারতের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী ঘৃণাকে উসকে দিয়েছে, শুধুমাত্র এই কারণে যে হিন্দুরা তার শাসনের অধীনে নিরাপদ বোধ করে।”
মিথ্যাচারে বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবকে ‘মানসিক ব্যাধিতে’ রূপান্তরিত করার অভিযোগ করেন হারুন।
মুহাম্মদ ইউনূসের শাসনামলে, গণমাধ্যম ‘দাস এবং নীরব’ হয়ে উঠেছে বলেও মূল্যায়ন করেন হারুন। তিনি লেখেন, “প্রতিদিনই বর্বরতা প্রকাশ পাচ্ছে—বিশ্বের কাছ থেকে লুকানো। চরমপন্থিরা বাংলাদেশিদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে পশ্চিম আর ইসলামি সন্ত্রাসকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না—যা উগ্রপন্থিদের মুক্ত হাত দিয়েছে।”
‘জিহাদিরা’ বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে উৎপাটন করেছে অভিযোগ করে হারুন লেখেন, “ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুছে দিয়েছে—ইউনূসের সরাসরি তত্ত্বাবধানে।”
জাদুঘর, ম্যুরাল, ভাস্কর্য এবং সাংস্কৃতিক প্রতীক ধ্বংস, শত শত সুফি মাজার এবং হিন্দু মন্দির ভেঙে ফেলেছে মন্তব্য করে পোস্টে লেখা হয়, “ইউনূসের শাসনে, নারীদের উপর নিপীড়নের দিক থেকে খুব কম দেশই এগিয়ে আছে।
“সংখ্যালঘু এবং ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা ক্রমাগত ভয়ে বাস করে, যখন হিযবুত-তাহরীর, আইএস এবং আল-কায়েদা তাদের লাল-কালো পতাকা উড়িয়ে ইসলামি ধর্মতন্ত্রের দাবি জানাচ্ছে। জুলাই-আগস্টের সন্ত্রাসীরা সরাসরি তাদের শ্রেণি থেকে এসেছে।”
ইউনূস এদেরকে আশ্রয় দিয়ে তিনি তাদের ক্ষমতায়িত করেছেন অভিযোগ এনে হারুন লেখেন, “তার সরকারে সন্ত্রাসীরা মন্ত্রী হিসেবে রয়েছে, এবং যাদের তিনি মন্ত্রী করতে পারেননি, তাদের তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন—তাদের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দিয়ে।”
বাংলাদেশ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল মন্তব্য করে পোস্টে লেখা হয়, “কিন্তু তার প্রথম শ্বাস থেকেই ইসলামপন্থি এবং জিহাদিরা এটিকে ছিন্নভিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছে।”
ইউনূসের ‘লোভের কোনো সীমা ছিল না’ দাবি করে হারুন আরও লেখেন, “ক্ষমতায় এসে তিনি নিজের অপরাধের তালিকা মুছে ফেলেছেন—ন্যায়বিচার থেকে পালিয়ে এবং শুধু একটি মামলায় ৬ হাজার ৬৩০ মিলিয়ন টাকা ‘আত্মসাৎ’ করেছেন।”
ইউনূসের দলবল বাংলাদেশ জুড়ে ‘উৎপাত’ চালাচ্ছে অভিযোগ এনে হারুন লেখেন, “তারা পুড়িয়ে দেয়, লিঞ্চ করে, নৃশংসতা চালায়—আর আমরা, শিকারেরা, কণ্ঠহীন, অদৃশ্য থেকে যাই।”
তার দৃষ্টিতে সংস্কারক নন, ইউনূস ‘প্রতারণায় আবৃত একজন স্বৈরাচারী’ হিসেবে প্রকাশ পেয়েছেন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ‘গাজার মতো’ রেখে গেছেন বলে ইউনূস যে মন্তব্য করেছেন, তারও সমালোচনা করে হারুন লেখেন, “একটি পরিকল্পিত, বিষাক্ত মিথ্যা যা তার উগ্র ইসলামপন্থি সমর্থকদের উত্তেজিত করার জন্য।
“শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশকে যত্ন করে গড়ে তুলেছিলেন, ইউনূস এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছে। তিনি এর অর্থনীতি ধ্বংস করেছেন, দাঙ্গা উসকে দিয়েছেন, এবং চরমপন্থীদের ক্ষমতায়িত করে দেশটিকে গৃহযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে গেছেন।”
ইউনূস সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ আনেন হারুন।
‘একটি চূড়ান্ত আবেদন’ হিসেবে তিনি লেখেন, “ইতিহাস ইউনূসকে মনে রাখবে, কিন্তু নায়ক হিসেবে নয়—কেবল একজন প্রতারক হিসেবে, যিনি বিশ্বকে প্রতারিত করেছেন এবং সন্ত্রাসে নেমে এসেছেন। নিজের জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি পশ্চিমের সেই সব সমর্থকদেরও অপমান করেছেন যারা এখনো তাকে সমর্থন করে।”
এই লেখা কোনো কূটনৈতিক নোট নয় উল্লেখ করে হারুন বলেন, “এটি একজন মানুষের কাঁচা, জরুরি কান্না, যার দেশ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, যার জীবন ভেঙে দেওয়া হয়েছে—ইউনূসের শাসনের দ্বারা শাস্তি পেয়েছে কেবল লেখার জন্য, ইতিহাস মনে রাখার জন্য, সত্যের প্রতি অনুগত থাকার জন্য।
“আজ আমি কণ্ঠহীন, একজন নিপীড়িত কূটনীতিক, একজন নির্বাসিত ঔপন্যাসিক যিনি প্রান্তর থেকে আকুতি জানাচ্ছেন। কিন্তু আগামীকাল, হয়ত আপনার নীরবতা, আপনার উদাসীনতা, ইতিহাসের নিন্দার মুখোমুখি হবে। এখন শুনুন—শুধু আমার কথা নয়, সেই লক্ষ লক্ষ নীরব কণ্ঠের কথা, যাদের কান্না মুহাম্মদ ইউনূস রক্ত আর মিথ্যায় ডুবিয়ে দিয়েছে।”