
প্রতীকী ছবি
দ্রুত নগরায়ণের কারণে জলাশয় ভরাটের ফলে ঢাকাসহ দেশের গ্রামগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে। জলাধার ভরাট বন্ধে আইন রয়েছে। তবে আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে। আমাদের দেশের জলাভূমির মধ্যে রয়েছে প্লাবনভূমি, নিচু জলা, বিল, হাওর, বাঁওড়, জলমগ্ন এলাকা, উন্মুক্ত জলাশয়, নদীতীরের কাদাময় জলা, জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত নিচু সমতলভূমি, দিঘি, পুকুর ও লবণাক্ত জলাধার। সাধারণত যেখানেই পানি, সেখানেই মাছের আবাস। তাই মৎস্য খাতে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম।
পৃথিবীর মোট আহরিত মাছের দুই-তৃতীয়াংশ আসে জলাভূমি থেকে। পানির রাসায়নিক উপাদান নিয়ন্ত্রণ ও অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান শোষণ করে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে জলাভূমি। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দূষিত পানি বিশুদ্ধকরণেও ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতি সংরক্ষণেও সংরক্ষিত জলাভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু প্রাকৃতিক কিংবা
কৃত্রিম কারণে দেশের দেশের খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খালের দুই পাশের জমির মালিকরা নিজেদের ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি করার কারণে খালগুলোর অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। অতিবৃষ্টি বা অতি পানি প্রবাহে সৃষ্ট বন্যার কারণে পানি ধারণ ক্ষমতাও নেই খালগুলোর। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এরই মধ্যে মরুকরণ হচ্ছে। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তাই পরিবেশ আইনানুযায়ী জলাধারের অধীন ভরাট ও বেদখল হওয়া জলাশয় সংস্কার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। জলাধার ভরাট রোধে বেশ কয়েকটি আইন ও বিধি রয়েছে। তবে আইন মানার বিষয়ে অনীহাও রয়েছে। দেশের সাত-আট লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এসব জলাধার ভরাটের ফলে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও নগরের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি শহরের বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে প্রতি বছর ৪২ হাজার একর কৃষিজমি ও জলাশয় ভরাট হচ্ছে। ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি ভরাট হয়েছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও আমরা জলাশয় ভরাট বা দখল হতে দেখি। আইন ভেঙে জলাশয় ভরাট হলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হচ্ছে না। যারা চিহ্নিত জলাশয়গুলো ভরাট করেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।
আইনে সুস্পষ্ট বলা আছে কোনটি জলাধার এবং তা কীভাবে রক্ষা করা যাবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আইন কিংবা পরিকল্পনা থাকলেই হবে না, প্রয়োগ থাকতে হবে। আমরা চাই, আইনের যথাযথ প্রয়োগ হোক এবং পরিবেশের স্বার্থে রক্ষা পাক জলাভূমি। সম্প্রতি হাইকোর্ট জলাভূমি রক্ষায় নড়েচড়ে উঠেছেন। কিছু নির্দেশনা গ্রহণ করেছেন। তবে জলাভূমি রক্ষায় জনগণেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। জলাধার ভরাট হতে দেখলে পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ দেওয়া যেতে পারে। স্থানীয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা জেলা প্রশাসকের কাছেও লিখিত অভিযোগ করা যায়। জলাভূমি রক্ষা করতে পারলে পরিবেশ বাঁচবে। আর পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সবার অংশগ্রহণ জরুরি।