Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো কি সম্ভব

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ১০:২০

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো কি সম্ভব

রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গত ১৪ মার্চ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রোহিঙ্গারা যেন আগামী বছর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারে, সে লক্ষ্যে তারা কাজ করবেন।

প্রশ্ন হলো, তারা কি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকেই আগামী রোজার ঈদের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা বলেছেন, নাকি কিছুসংখ্যক? যদি কিছুসংখ্যক হয়, তাহলে সেই সংখ্যাটি কত? যদি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়, সেটিও এই সংকট নিরসনে একটি বড় অগ্রগতি হবে। কেননা মিয়ানমার কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত নিলেও সারা বিশ্বে এর মধ্য দিয়ে একটি বার্তা দেওয়া যাবে যে, মিয়ানমার সরকার তাদের দায় স্বীকার করেছে এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে তারা আন্তরিক। পরবর্তী সময়ে এই উদাহরণ কাজে লাগিয়ে আরো বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এটি সম্ভব বলে মনে হয় না।

যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের দেশের নাগরিকই মনে করে না, তাদের কেন ফেরত নেবে? বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনাটি ঘুরপাক খায় তাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে। অথচ রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের নাগরিক, সেটি প্রমাণের কিছু নেই। কিন্তু ২০১৭ সালের জাতিগত নিধনের আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে মিয়ানমার। মূলত তাদের দেশের জনগণের মনেও রোহিঙ্গাবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া এবং নির্যাতন জায়েজ করার ক্ষেত্রেও দেশটির সরকার এই অস্ত্রটিই ব্যবহার করে যে, তারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। সুতরাং এখন মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ইস্যুতে যে নাগরিকত্বের প্রশ্নটি আসছে এবং মিয়ানমার যে প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে চায় (আসলে প্রমাণ করতে চায় না) সেটি বেশ জটিল। তা ছাড়া রোহিঙ্গারা যখন জীবন নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, তখন তারা পৈতৃক সম্পত্তির কোনো দলিল বা সে দেশের নাগরিকত্বসংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র সঙ্গে আনতে পারেনি। তাদের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ওই সব কাগজপত্র তারা হয়তো কোনো দিন জোগাড় করতে পারবে না। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের সেই সুযোগও দেবে না।

সুতরাং বাংলাদেশ বা জাতিসংঘ কি তাদের ওপর এমন কোনো চাপ প্রয়োগ করতে পারবে বা এমন কোনো কৌশল কি জাতিসংঘের আছে, যার মাধ্যমে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার ফেরত নেবে? যদি তাই হতো, তাহলে এতদিনে অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নিত। কিন্তু নেয়নি। বরং বছরের পর বছর ধরে এই সংকট নিয়ে কথা হলেও এমনকি রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধসহ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চারটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও মিয়ানমার সরকার এসব পাত্তা দেয়নি।

মিয়ানমার সরকার এবং আরো একাধিক পক্ষ যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় না, তার বড় প্রমাণ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে উখিয়ার কুতুপালংয়ে শরণার্থীশিবিরে গুলি করে হত্যা করা। মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে শরণার্থীদের সংগঠিত ও বিশ্বজনমত সৃষ্টির জন্য দেশে-বিদেশে কাজ করেছেন। বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট শরণার্থীশিবিরে মিয়ানমারের গণহত্যাবিরোধী মহাসমাবেশে কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ ঘটান তিনি। ওই দিনটিকে তিনি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেন। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও তিনি কথা বলার সুযোগ পান। কিন্তু সেই মুহিবুল্লাহকেই পরবর্তী সময়ে হত্যা করা হয়। অনেকে মনে করেন, মিয়ানমার চায় না প্রত্যাবাসন আন্দোলন জোরদার হোক। ফলে তাদের গুপ্তচরেরাই হয়তো রোহিঙ্গাদের গ্রুপিং ও কোন্দল উসকে দিয়ে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করিয়েছে।

রোহিঙ্গা কূটনীতিতে বাংলাদেশের সফলতা কতটুকু, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে গত বছরের নভেম্বরে সাবেক কূটনীতিক খলিলুর রহমানকে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, গত প্রায় চার মাসে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তিনি কী কী করেছেন? যে মিয়ানমারে এই সমস্যার উৎপত্তি এবং যারা এই সংকটের প্রধান স্টেকহোল্ডার, সেই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কি তার কোনো বৈঠক হয়েছে?

এটা ঠিক যে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের মানবিক মর্যাদাসহ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো অথবা তাদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকটের সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে জাতিসংঘের আয়োজনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনেরও তাগিদ দিয়েছিলেন এবং সেই সম্মেলনটি এই বছরের সেপ্টেম্বরে হওয়ার কথা।

যদি সত্যিই সব স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণে এ রকম একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে যদি রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ কীভাবে ভিকটিম হচ্ছে, সেটি মিয়ানমারকে বোঝানো যায় এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি অথবা বাধ্য করানো যায়, সেটি একটি বিরাট অগ্রগতি হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মিয়ানমারকে রাজি অথবা বাধ্য করানো যাবে কি না? কোন পদ্ধতিতে তাদের বাধ্য করা যাবে? জাতিসংঘ কি তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে? নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেই কি সে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে?

দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও মিয়ানমারের সম্মতি লাগবে। কারণ জাতিসংঘ চাইলেই মিয়ানমারের ভূখণ্ডে কোনো একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলতে পারবে না। রাখাইনে এখন আরেকটি সংকটের নাম আরাকান আর্মি। এই সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী রাখাইনে স্বায়ত্তশাসন তথা একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য লড়াই করছে। ফলে সেখানে কোনো নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলতে হলে এখন আরাকান আর্মিও বড় স্টেকহোল্ডার। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই হয়তো গুতেরেস পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন এবং তাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপে বসা জরুরি। যদিও তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই প্রশ্নও উঠছে যে, জাতিসংঘ কি তাহলে আরাকান আর্মির মতো একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি তাদের সমর্থন দিয়ে গেল? তারা যে রাখাইনে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, সেই প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ তাদের পাশে থাকবে এবং বাংলাদেশও যাতে তাদের সমর্থন দেয়, তিনি সেই তদবিরও করলেন!

যাই হোক না কেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো এখন আর কঠিন অবস্থার ভেতরে নেই, বরং অনেকটা অসম্ভবের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সে কারণেই হয় তাদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা, না হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসনের চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় তাদের যদি বাংলাদেশেই রাখতে হয় তাহলে অতি উচ্চ জন্মহারের এই জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা আগামী ২০ বছর পরে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলাই বাহুল্য এবং তখন বাংলাদেশ সেই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করবে, বিশেষ করে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা ও দাতা দেশগুলো যদি তাদের খাদ্য-বস্ত্র-চিকিৎসা-স্যানিটেশন-শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না দেয়, তাহলে কী পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

বাংলাদেশ নিজেই যেখানে বিপুল জনসংখ্যার চাপে ন্যূব্জ, সেখানে অন্য দেশের লাখ লাখ মানুষকে অনন্তকাল আশ্রয় দেওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বরং রোহিঙ্গারা খুব বেশিদিন এখানে বসবাস করতে থাকলে তারা নানাভাবে বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাবে এবং তখন তাদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের নানা ইস্যুতে সংঘাত তৈরি হবে, যা আরেকটি বড় সংকটের জন্ম দেবে।

অতএব যেভাবেই হোক, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো এবং সে জন্য মিয়ানমার সরকারকে রাজি করানো না হয় তাদের বাধ্য করা; এটি না হলে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা এবং সেটিও সম্ভব না হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাতে তাদের পুনর্বাসন করা যায়, সে বিষয়ে জাতিসংঘকে ভূমিকা রাখতে হবে। না হয় এই বিরাট বোঝা বাংলাদেশকেই বইতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫