
প্রতীকী ছবি
মাগুরার আট বছরের শিশু আছিয়া ধর্ষণের লোমহর্ষক ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সারা দেশ থেকে ধর্ষণের যে খবরাখবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে, তা দেশের মানুষকে রীতিমতো হতবাক করে দিয়েছে। আছিয়ার নিথর দেহ চিৎকার করে বলে গেছে, আমাদের এই রাষ্ট্র, সমাজ তাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। হাজারো আছিয়া, নুসরাত, তনুর নিরাপত্তা দিতে পারে না।
ইউনিসেফের এক তথ্য থেকে জানা যায়, গত আট বছরে দেশে তিন হাজার ৪৩৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম আর সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে আছে ৯৩৩ জন। ধর্ষকের বিচারের দাবিতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ ও রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনগুলো প্রতিবাদ, বিক্ষোভ আর মিটিং-মিছিলে দেশকে উত্তাল করে তুলেছে।
এরই মধ্যে আইন উপদেষ্টা ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের বিচারের সময় সীমা বেঁধে দিয়ে আইন সংশোধনের কথা বলেছেন। ধর্ষণের ভয়াবহতা রোধে দ- বিধি থেকে আলাদা করে ধর্ষকের বিচারের জন্য ১৯৮৩ সালে নারী নির্যাতন (নিবর্তক) শাস্তি অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ধরন ও রূপ পাল্টে নির্যাতনের ব্যাপকতা অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৮৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনটি প্রণীত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৫ সালে আইনটি ঘষামাজা করে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন প্রণীত হয়।
২০০০ সালে ১৯৯৫-এর আইনটি বাতিল করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও কঠোর শাস্তির বিধান করে বর্তমান আইনটি প্রণীত হয়। বিদ্যমান আইনটি যে অবস্থায় আছে তা ধর্ষণের বিচারে কতটুকু কার্যকর আমরা সেটি দেখতেই পাচ্ছি। দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে মামলার স্তূপ জমে আছে। কঠোর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন থাকা সত্ত্বেও দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ধর্ষক শিশু নির্যাতনকারী আদালত থেকে খালাস পাচ্ছে, ফলে ধর্ষণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, নারী নির্যাতন থামছে না।
বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার বিচার করার বর্তমান সময়সীমা ১৮০ দিন হলেও একটা মামলা চলে বছরের পর বছর। বিচার প্রার্থী আর আসামি উভয় আদালত, পুলিশ আর কোর্ট-কাচারিতে অর্থ ও সময় অপচয় করছে আর চরকির মতো ঘুরছে। এই সময়ের মধ্যে কেন বিচার নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না, এর সমাধান না করেই নতুন করে ৯০ দিন সময়সীমা বেঁধে দেওয়া কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সময়সীমা বেঁধে দিয়ে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা যায় না। প্রকৃত অর্থে বিদ্যমান আইনের বিচার নিষ্পত্তিতে কালক্ষেপণের কারণগুলো চিহ্নিত করে সংশোধন বা প্রতিকারের ব্যবস্থা করলে বিচারপ্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতা কমবে এবং সমাজে অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা কমবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
২০০০ সালের (২০২০ সালে সর্বশেষ সংশোধন) ১৮ ধারার অপরাধ তদন্তে সময়সীমা সাত কার্য দিবস এবং ৩০ কার্য দিবস যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে, নাকি তদন্ত সেখানে বিলম্বিত হচ্ছে তা সর্বপ্রথম খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর চার্জশিট অথবা ফাইনাল রিপোর্ট যাই হোক না কেন, শুরু হয় ইঁদুর বিড়ালের দৌড় খেলা। পুলিশি তদন্তে ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল হলে বাদীপক্ষ নারাজি আবেদন করে মামলাকে বিচারের মুখ দেখানো থেকে ঝুলিয়ে রাখতে পারে অনন্তকাল। আবার অভিযোগপত্র বা চার্জশিট দাখিল হলে আসামি পক্ষ একই কায়দায় মামলাকে কৌশলে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে পারবেন বছরের পর বছর। এ পর্যায়ে মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণ শুধুই আইনি জটিলতা। পুলিশ, আইনজীবী, বিজ্ঞ আদালত কারোই কোনো কসুর নেই। পুলিশ প্রতিবেদনের সাতকাহন শেষ হওয়ার পর মামলা আসে সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে। এই পর্যায় এলে দেখা যায় মামলার বাদী অথবা ভিকটিম যে ঠিকানা দিয়ে মামলা করেছেন, সেখানে থাকেন না। কোথায় চলে গেছেন তারও হদিস নেই। পুলিশও বলতে পারে না বাদী অথবা ভিকটিমের ঢেরা এখন কোথায়। আদালত থেকে নোটিশের পর নোটিশ দিয়েও তার হদিস পাওয়া যায় না। মামলার আসামি আদালতের বারান্দায় আসে আর যায়, বছরের পর বছর। পুলিশ মামলার প্রাথমিক অবস্থায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় যেসব সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে ছিল, তাদের খুঁজে পায় না। যদিও বা খুঁজে পান সাক্ষী ভুলে যান মামলার ঘটনা। এতকাল পর কীভাবেই মনে থাকে, আসামিপক্ষের বিজ্ঞ কৌঁসুলির জেরার দাপটে ভুলভাল বলে দেন। সুতরাং প্রকৃত ঘটনা উদঘাটিত হয় না।
অনেক ক্ষেত্রে অবিবাহিত ভিকটিম বা বাদীর বিবাহ হয়ে যায়। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে আর লোক লজ্জার ভয়ে সাক্ষ্য দিতে আসেন না। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এত বছর পর সাক্ষ্য দিতে এসে সব গুলিয়ে ফেলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি আবার অবসরে চলে যান। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
ভিকটিমকে মেডিক্যাল পরীক্ষা করে যে ডাক্তার সার্টিফিকেট দিয়েছেন তার সাক্ষ্য গ্রহণেও একই প্রক্রিয়ায় কালক্ষেপণ হয়। আসামিপক্ষ অধিক ফিস দিয়ে অভিজ্ঞ দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করেন। বাদী বা ভিকটিমের আইনজীবী হচ্ছে সরকার নিয়োজিত। যিনি বা যারা রাজনৈতিকভাবে নিযুক্ত হন, যোগ্যতা অভিজ্ঞতায় রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ কর্মী। মামার ক্ষমতায় ভাগ্নে এপিপি, পিপি। যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার নেই প্রয়োজন। আসামিপক্ষের সঙ্গে সারাক্ষণ শলাপরামর্শ, বাদীপক্ষের খবর রাখেন না। বাদীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য রেকর্ড পড়িয়ে কখন কী বলতে হবে কিছুই বুঝিয়ে দেন না। যার অনিবার্য পরিণতি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে দায়েরকৃত ৮০ শতাংশ মামলায় আসামি খালাস পাচ্ছেন। এসব খালাস পাওয়া আসামির বিরুদ্ধে সরকারপক্ষে কোনো আপিলের পদক্ষেপও নেওয়া হয় না।
এসবই হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলা বিচারের প্রকৃত চিত্র। তাই সময় বেঁধে দিলেই যে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বিচার হবে- এই নিশ্চয়তা দেওয়া কি সম্ভব? বিদ্যমান আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি হচ্ছে না কেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।
ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ আইনজীবী মো. বশির উল্যাহর কাছে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে দায়েরকৃত মামলার বিচারের দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের কারণ জানতে চেয়েছিলাম। উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান আইনের ত্রুটির কারণেই দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
একই প্রশ্নে অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রব হাওলাদার জানান, মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন কারণে বিচার বিলম্বিত হয়। তবে তিনি বিচার বিলম্ব হওয়ার জন্য আইনজীবীদের ভূমিকাকেই সবচেয়ে দায়ী করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা বিকাশ সরকার বলেন, মামলা তদন্ত পর্যায়ে সময়ক্ষেপণের বহুবিধ কারণ রয়েছে। অন্যতম একটি কারণ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তার ঘাটতি, অত্যধিক কাজের চাপ। অপরাধের চাক্ষুস সাক্ষ্য না পাওয়া ভিকটিম অথবা বাদী প্রাথমিক অবস্থায় মামলা করলেও বিভিন্ন সামাজিক দিক বিবেচনা করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সত্যিকার ঘটনা তারা প্রকাশ করতে চান না। অনেক ক্ষেত্রে আসামিদের সঙ্গে আপস করে মামলা নিয়ে এগোতে চান না। তিনি আরো বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও দ্রুত বিচার হয় না, মামলা গড়াতে থাকে বছরের পর বছর। দ্রুত বা নির্দিষ্ট সময়ে বিচার নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে মামলার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি হচ্ছে। বিচার প্রার্থীর ভোগান্তি চরম মাত্রায় পৌঁছেছে।
সুতরাং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা নির্ধারণ যথেষ্ট নয়, বরং যেসব কারণে মামলায় বিচার বিলম্বিত হয় তা চিহ্নিত করা দরকার।
লেখক : অ্যাডভোকেট