ভারতকে নিয়ে ‘যৌথ অর্থনীতি’ গড়ার প্রত্যাশায় ইউনূস

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫, ১৯:৩৭

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি- সংগৃহীত
ভারতসহ চারটি দেশকে নিয়ে যৌথ অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রত্যাশার কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠন করা সরকারের প্রধান এই আগ্রহের কথা তুলে ধরেন।
আগে থেকেই রেকর্ড করে রাখা এই ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি টেলিভিশনগুলো সম্প্রচার করেছে।
এই ভাষণে আওয়ামী লীগ শাসনামলের নানা সমালোচনার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসের শাসনামলে নেওয়া নানা পদক্ষেপের ‘সাফল্য’ এবং সরকারের স্বপ্নের কথা উঠে আসে।
ইউনূস বলেন, “বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।”
ভাষণে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে এবং প্রতিবেশী ভারতকে নিয়ে একটি যৌথ অর্থনীতি গড়ার প্রত্যাশার কথা বলেন তিনি, যাতে আরও দুটি দেশকে রাখা হবে।
তিনি বলেন, “আমাদের পণ্য, পৃথিবীর পণ্য। এই পণ্য নেপালে যাবে, ভুটানে যাবে, ভারতের সেভেন সিস্টার্সে যাবে।
“প্রতিবেশীদের পণ্য আমাদের এখানে আসবে, সারা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে যাবে, এভাবেই এটি একটি লাভজনক অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। আর এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে বাংলাদেশ।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি বরাবরই বলে এসেছি, আমরা মহা সৌভাগ্যবান এক জাতি, পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের অবস্থানের কারণে।
“বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান—দক্ষিণ এশিয়ার এই চারটি দেশ মিলে একটি যৌথ অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারলে চার দেশই লাভবান হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের রয়েছে এক বিস্তীর্ণ মহাসাগর। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আমাদের সামনে বিরাট অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছে।
“কুমিরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ উপকূল ভূমি। এই দীর্ঘ উপকূলজুড়ে বিরামহীনভাবে অনেকগুলি আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক মানের সমুদ্র বন্দর, শিল্প কারখানা, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা স্থাপন করা গেলে পুরো অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভবিষ্যৎ দ্রুত পরিবর্তন সম্ভব।”
নেপাল-ভুটানের জলবিদ্যুৎ তাকিয়ে বাংলাদেশ
নেপাল ও ভূটান বাংলাদেশর জলবিদ্যুৎ দিতে অত্যন্ত আগ্রহী জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরাও নিতে আগ্রহী।”
নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আনতে পারলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা কমবে বলে মত দিয়ে ইউনূস বলেন, “বর্তমানে বিশ্ববাসী পরিবেশ রক্ষায় সচেতন। তারা এটাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব বিকল্প পাওয়া গেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করা যাবে।”
বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে নেপাল ও ভুটার থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কোনো বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ যথাসময়ে শেষ করার বিষয়েও সরকার জোর দিয়েছে বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “রোসাটমের মহাপরিচালক আমাকে বলেছেন, শিগগির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে।”
লক্ষ্য বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নেওয়া
বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে ‘অনন্য উচ্চতায়’ নিয়ে যাওয়া সরকারের অন্যতম লক্ষ্য বলেও উল্লেখ করেন ইউনূস।
এ লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ১০টি রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা আসিয়ানের সদস্য হিসেবে যোগদান করার বিষয়ে আগ্রহের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এ বছরের শুরু থেকে মালয়েশিয়া আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। মালয়েশিয়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি আমাদের আবেদনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, আমাকে মালয়েশিয়া সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি।”
মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘের সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব নিয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যে সমস্ত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সবগুলো সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে তারা কাজ করছে।”
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইটে গণহত্যার কথাও তুলে ধরেন ইউনূস। তিনি বলেন, “মানব সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত এক হত্যাযজ্ঞের দিন। ১৯৭১ সালের আজকের রাতে পাক হানাদার বাহিনী নিরপরাধ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করেছে। ২৫ শে মার্চ থেকেই এ দেশের মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ৯ মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।”
মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের পাশাপাশি ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানান প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদেরকে যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এনে দিয়েছে, সে সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে চাই।”
চীন সফরে কী হবে
সরকার গঠনের পর প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরে চীন যাওয়ার বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন ইউনূস। তিনি বলেন, “চারদিনের সফরে আমি চীন যাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আমার বৈঠক হবে। চীনের বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সিইওদের সঙ্গেও বৈঠক করব।”
এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে বলে আশা করে সরকার প্রধান বলেন, “পৃথিবীর সর্ববৃহৎ চাইনিজ সোলার প্যানেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লংজি বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের আগ্রহ জানিয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করছি।”
প্রযুক্তিগত সহায়তা, মেডিকেল সহায়তা, স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসহ অন্যান্য বিষয়ে এই সফরে আলোচনা হবে জানিয়ে ভাষণে বলা হয়, “তারা আমাদের দেশ থেকে আম, কাঁঠাল ও পেয়ারা আমদানি করতে চায়। এটা খুব দ্রুতই শুরু হবে।”