
প্রতীকী ছবি
ঈদ যাত্রার প্রধান চ্যালেঞ্জ ট্রেন-বাস-ট্রেন ও আকাশপথের টিকিট পাওয়া। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবারের ঈদ যাত্রাটি ভিন্ন হওয়ার কথা। কেননা এবার দীর্ঘ ছুটির ফাঁদে দেশ। বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীরা টানা ৯ দিন ছুটি পেয়েছেন। তবে কৌশল করে অনেকে এই ছুটি ১১ দিন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবেন।
৩১ মার্চ (সোমবার) ঈদুল ফিতর ধরে আগেই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। এর আগে-পরে (২৯ ও ৩০ মার্চ এবং ১ ও ২ এপ্রিল) চার দিন ছুটি থাকছে নির্বাহী আদেশে। তার আগে ২৮ মার্চ শুক্রবার। শবেকদরের ছুটিও এদিন। সে হিসাবে ২৮ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ছয় দিনের ছুটি। ঈদের পরে ৩ এপ্রিল নির্বাহী আদেশে ছুটি ঘোষণা করায় আরো তিন দিন যুক্ত হয় ছুটির তালিকায়। কারণ এর পরের দুই দিন শুক্র ও শনিবার। সরকারি চাকরিজীবীদের শেষ অফিস ২৭ মার্চ (বৃহস্পতিবার)। এর আগের দিন আবার ২৬ মার্চের ছুটি। সে হিসাবে ঈদের আগের বৃহস্পতিবার ছুটি মিললে ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১১ দিনের ছুটি কাটানো সম্ভব। তবে এই সুযোগ সবাই পাবেন না। শুধু জরুরি সেবার সঙ্গে যুক্ত নন সরকারি কর্মচারীরাই এই সুযোগ পাবেন। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও হয়তো ১১ দিন না হলেও এবার একটা লম্বা ছুটিতে যাবেন। সে হিসাবে এবার ঈদে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়বেন বা এরই মধ্যে ছেড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নাগরিক সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) তথ্য বলছে, এবার ঈদে প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ বৃহত্তর ঢাকা ছাড়বে। তারা ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরসহ ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলার স্থায়ী-অস্থায়ী বাসিন্দা। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের ৬০ শতাংশ যাবে সড়কপথে। বাকি ৪০ শতাংশ নৌ ও রেলপথে।
যেহেতু একসঙ্গে অনেক বেশি মানুষ ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে দেশের নানা প্রান্তে ছুটি কাটাতে যাবেন, ফলে স্বাভাবিকভাবেই যানবাহনের, বিশেষ করে ট্রেনের টিকিটের চাহিদা অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি। এবার ট্রেনের শতভাগ টিকিট দেওয়া হয়েছে অনলাইনে। http://eticket.railway.gov.bd/ এবং সহজ ডটকমের সাইট http://shohoz.com/bn থেকে যাত্রীরা টিকিট কিনেছে।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, অনলাইনে ২৭ মার্চের টিকিট কাটতে সোমবার (১৭ মার্চ) সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মাত্র আধাঘণ্টায় দেড় কোটি হিট বা টিকিট কাটার চেষ্টা করা হয়েছে। ২৭ মার্চ ট্রেনে যাতায়াতের জন্য ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোর আসনসংখ্যা ৩৩ হাজার ১৯৯টি। সারা দেশে এই আসন এক লাখ ৭৩ হাজার ২৭৯টি। তার মানে যারা টিকিট কাটার চেষ্টা করেছে, বেশির ভাগই টিকিট কাটতে পারেনি বা যারা চেষ্টা করেছে, তাদের খুব সামান্যসংখ্যক মানুষের ভাগ্যেই রেলের টিকিট জুটেছে। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ট্রেনের টিকিটের সংখ্যা যে কত কম, এর মধ্য দিয়ে সেটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
কথা হয় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। গণমাধ্যমে কাজ করেন বলে টানা ১১ দিনের ছুটি ভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি। বরং তিনি ২৭ মার্চ লালমনিরহাট যাওয়ার জন্য অনলাইনে টিকিট কেটেছেন। টিকিট কাটতে গিয়ে দারুণ ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়েছে এবং সার্ভারে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরে টাকা পরিশোধেও বেশ সময় লেগেছে জানিয়ে জাহিদ বললেন, এত সব হ্যাপা শেষেও যখন টিকিটটি প্রিন্ট করতে পারলেন, তখন তার মনে হলো হাতে চাঁদ পেয়েছেন। কেননা যে কষ্টটুকু করতে হয়েছে, তা অফিসে বসেই। অন্তত রেলস্টেশনে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়নি। তিনি মনে করেন, অনলাইনে টিকেটিং যাত্রীদের দুর্ভোগ কমালেও যেহেতু চাহিদার তুলনায় ট্রেন ও বগির সংখ্যা কম, তাই বেশির ভাগ মানুষের চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। তার পরামর্শ, প্রতিটি রুটে ট্রেন ও বগির সংখ্যা যেন বাড়ানো হয়। ট্রেনের গতি বাড়িয়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুত যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া; রেলপথ নির্বিঘ্ন রাখা এবং সময়মতো প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শও তার।
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সুমাইয়া শিউলি। ঈদ করতে যাবেন বরিশাল বিভাগের পিরোজপুরে। পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন ঢাকা থেকে চার ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। তিনি বললেন, স্বাভাবিক সময়ে বাসস্ট্যান্ডে গিয়েই টিকিট পাওয়া যায়। কেননা ওই রুটে একাধিক কোম্পানির বাস চলে। কিন্তু ঈদের সময় তাৎক্ষণিকভাবে বাসের টিকিট পাওয়া যায় না। ফলে তিনি খুব সহজেই অনলাইনে কাঙ্ক্ষিত বাসের টিকিট কাটতে পেরেছেন। তার ভাষায় : ‘আমাদের বাস টার্মিনালগুলো এখনো সে রকম নারীবান্ধব নয়। ফলে সেখানে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে কিংবা মানুষের ভিড় ঠেলে টিকিট কাটা এবং সে জন্য ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে সায়েদাবাদ যাওয়া-আসার যে হ্যাপা, সেটি দূর করে দিয়েছে অনলাইন টিকেটিং।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই অনলাইন টিকেটিং ব্যবস্থা পরিবহন খাতে স্বচ্ছতা আনায় বড় ভূমিকা পালন করে। কালোবাজারি প্রতিহত করতেও ভূমিকা রাখে। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে কাটতে হয়, ফলে সরকারের পক্ষে একটি ডাটাবেইস সংরক্ষণ করাও সহজ হয়।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে সহজ ডটকম, বিডি টিকেটস, বাসবিডি, পরিবহন ডটকম, যাত্রী ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে যাত্রীরা সহজেই টিকিট কিনতে পারছে। সহজ ডটকমের তথ্য বলছে, তারা বর্তমানে তিন হাজার রুট এবং সাড়ে সাত হাজার কাউন্টারসহ দেশের প্রায় সব জেলায় সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার বাস টিকিট অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে প্রায় ৪৫ শতাংশ যাত্রী যাত্রার এক সপ্তাহ অনলাইনে টিকিট কাটেন।
তবে অনলাইন টিকেটিং ব্যবস্থায় যাত্রীদের অভিযোগও কম নয়। বিশেষ করে একযোগে হাজার হাজার মানুষ টিকিট কিনতে গিয়ে সিস্টেমে বাড়তি চাপ পড়ে বলে সার্ভার ডাউন হয়ে যায়। বিশেষ করে ঢাকা থেকে কক্সবাজার, সিলেট, রাজশাহী রুটে চাহিদা বেশি থাকায় এসব রুটে যাত্রীদের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এমতাবস্থায় উন্নত প্রযুক্তি ও সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরো শক্তিশালী এবং যাত্রীবান্ধব করে তোলা জরুরি। বিশেষত, রুটে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সিস্টেমের চাপ কমানোর জন্য উন্নত নেটওয়ার্ক সিস্টেম চালু করা প্রয়োজন বলে যাত্রীরা মনে করেন।